‘জানো, একা কোনো কিছু আমার লাগে না ভালো’, বাবার এই কবিতার লাইন নিজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল: তিতি রায়

পঁচিশে নভেম্বর কবির দিন, কবিতার দিন— কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। কবিকন্যা তিতি রায়ের সঙ্গে কবির চেনা-অচেনা দিক নিয়ে একান্ত কথোপকথনে মঞ্জিস রায়।
এই অনিশ্চিত দিনগুলোতে কোনও কোনও সৃষ্টি আমাদের ভাবায়, আমাদের ভালোবাসার ক্ষমতাকে মলিন হতে দেয় না। ‘পোড়াতে পারে না’ কবিতার সেই অমোঘ লাইনগুলো এই সময়ে খুব মনে পড়ে—
“সেই কাগজের নৌকো আজো জলে ভাসে
গুরুত্ব মানে না কোনো সংবাদের সুখের-দুঃখের
রক্তবর্ণ ছাপছোপ, দাঁড়িকমাশূন্য বাংলাভাষা,
পরীক্ষানিরীক্ষা গদ্যে, যাত্রাসম্মেলন, আগুপিছু।
কিছুই না-জেনে, সেই কাগজের নৌকো ভেসে যায়
মেধার বিষণ্ণ অগ্নি কিছুতেই পোড়াতে পারে না।”

মোটামুটি কবে থেকে তুমি অনুভব করতে পারলে যে, তোমার বাবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলা কবিতার জগতে এক নক্ষত্রের নাম, যিনি নাকি তোমার অন্য বন্ধুদের বাবার থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা?
ছোট থেকেই অন্যরকম কিছু একটা বুঝতাম। কারণ আমরা সব সময় বাবার সঙ্গে কবিতাপাঠের আসরে যেতাম। সেখানে বাবাকে ঘিরে উন্মাদনা, উত্তেজনা কোনও না কোনওভাবে বুঝতাম।
মানুষ শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে কি কখনও আলাদা মনে হয়েছে? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার জগতের সঙ্গে পরিচয় কোন বয়স থেকে?
আলাদা, আবার একইরকম। জীবনযাপন যদি ধরো। কবিতার সঙ্গে জ্ঞান হওয়ার আগের থেকেই প্রায় পরিচয়। কারণ শুনতাম তো কবিতাপাঠ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোনও কম আলোচিত দিকে যদি একটু আলোকপাত করো…
বাবা খুব ভালো সংগঠক ছিল। কবিতা পত্রিকা বার করেছে নানা সময়, যদিও নানা কারণে সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সব রিপোর্টাজ একত্রিত করে বই বের করেছিল, ‘সাংবাদিকের চোখে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ’। তার পরেও দুই বাংলার কবিতা, গল্প বই আকারে বের করেছে। বাংলাদেশের প্রতি বুকের টান, দেশবিভাগ মানতে না পারার বেদনা এদেশে জন্মেও কোনও অংশে কম অনুভব করেনি। তারপর ১৯৮৫ সালে কবিতা উৎসব সংগঠিত করল সৌমিত্র মিত্রর সাহায্যে। সেখানেও প্রতিবেশী রাজ্যগুলো থেকে অন্য ভাষাভাষীর অনেক কবিকে আমন্ত্রণ জানানো, তাঁদের ইনভলভ করা… পরের বছর বাংলাদেশ থেকে একদল কবিকে আমন্ত্রণ করা… সবাই মিলে একসঙ্গে একটা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা নিয়েছিল। ‘জানো, একা কোনো কিছু আমার লাগে না ভালো’ বাবার এই কবিতার লাইন নিজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কোন কবিতা সবথেকে প্রিয়? যেকোনও একটা কবিতার কথা বলতে গেলে কোন কবিতার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
অসংখ্য। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘নিজেকে চার টুকরো করে’।
তাঁর সঙ্গে কাটানো শৈশব-কৈশোরের কোনও মুহূর্ত যদি একটু স্মৃতি হাতড়ে এখানে ভাগ করে নাও…
প্রচণ্ড স্নেহ, বুক ভরে থাকা আদর আর ছেলেমানুষি। একসঙ্গে সময় কাটানো, বেড়াতে যাওয়া, প্রশ্রয়, বাবাকে বকাবকি, আবার বাড়ি না ফেরার জন্য দুশ্চিন্তা, ভয়। সবই।
পারিবারিক জীবনের প্রভাব কি কখনও কবিতায় বা সাহিত্যে পড়েছে? কীভাবে?
অনেক অনেক কবিতায়, ছড়াতে তো বটেই, তার ছায়া পড়েছে।
“ছেলেটি ঘুমন্ত হাতে জড়িয়েছে নিষ্ঠুর
পিতাকে, যিনি সদা ভ্রাম্যমাণ…”
আমাকে নিয়েও আছে। মা (মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়)-কে নিয়ে তো প্রচুর, কবিতায় ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ বিখ্যাত। এছাড়াও গৌরী মাছির উল্লেখ মাকে উদ্দেশ্য করে।

তোমার নিজের জীবনে ওনার প্রভাব কতখানি?
আমার জীবনে মা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যত বয়স বাড়ছে, ততই সেটা বাড়ছে। কিন্তু বোধের ভিতরে বাবার সাহিত্যভাবনা, কবিতা, গদ্য, যাপন, মানুষকে ভালোবাসার সহজাত ভাব আজন্ম ছাপ ফেলে গেছে।
সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওনার সখ্যের কথা আমরা জানি। যদি স্মৃতি হাতড়ে কিছু বলো…
হ্যাঁ সে তো আছেই। তার মধ্যে একটা সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে বাবার অন্তরঙ্গ কথোপকথন, ১৯৮২/৮৩ সালের অষ্টমীতে, ওঁর বাড়িতে। ওঁর কবিতার পাঠক শুধু নয়, প্রথম বই প্রকাশনার ব্যবস্থাও বাবা করেছিল। কলেজের সময় থেকেই আলাপ, বন্ধুত্ব ছিল, টান অটুট ছিল বাবা চলে যাবার পরও। উনি বাবার কবিতার ভক্ত ছিলেন, একথা বহু জায়গায় বলেছেন।

ছবি সৌজন্যে তিতি রায়
দারুন লাগলো ❤️
খুব সুন্দর।