ঘুরতে ঘুরতে লাদাখ (চতুর্থ পর্ব)

নীলাঞ্জনা মাহাত
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব ৮০ কিমি। মোটামুটি আড়াই ঘণ্টামতো লাগে। রাস্তা ভালোই, কোনও কোনও অংশে খানিক অপ্রশস্ত। রাস্তার পাশে কখনও চাষের জমি, গাছপালা। পাশে সিন্ধ নদীও। ছোট-বড় নীলচে সবুজ পাহাড়। প্রকৃতি অকৃপণ। কখনও দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফ। মাঝেমাঝে লোকালয়, বাড়িঘর পেরোচ্ছি। তবে কোথাও ঘিঞ্জি নয়। রাস্তায় খুব বেশি গাড়িও চোখে পড়েনি, বাসও খুব কম।
আরও পড়ুন: ঘুরতে ঘুরতে লাদাখ (প্রথম পর্ব)

গন্ডেরবাল পেরিয়ে একটা ছোট গঞ্জ মতো জায়গায় একটি ছেলে রাস্তায় হাত দেখিয়ে গাড়ি দাঁড় করাল। অবাকই হলাম। ওখানে কয়েকটা দোকানপাট আছে, লোকজন ও আছে। আমাদের ড্রাইভারের সঙ্গে তার কথাবার্তায় বুঝলাম, ১০-১৫ কিমি দূরে তার বোনের বাড়ি। সেই বোন ছেলেকে নিয়ে ফিরবে, কোনও বাস, গাড়ি পাচ্ছে না, আমরা যদি লিফট দিই। ড্রাইভার আমাদের কাছে অনুমতি চাইল, তার আপত্তি ছিল না। এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা ছিল, তারপর ভাবলাম, কয়েক কিমি রাস্তা আর একটা মানুষকে একটু এগিয়ে দিতে পারব না! রাজি হলাম, শুধু ড্রাইভার ছেলেটিকে বললাম, ভাই, মেন রাস্তা থেকে কোথাও এদিক-ওদিকে ঢুকব না। রাস্তার ওপরে যেখানে বলবে, নামিয়ে দেব।
আরও পড়ুন: ঘুরতে ঘুরতে লাদাখ (দ্বিতীয় পর্ব)

অল্পবয়সি মেয়ে, সঙ্গে ৬-৭ বছরের একটি ছেলে। তাদের দু’জনকে তুলে নিলাম। সামান্য কিছু কথাবার্তা হল। পথেঘাটে অনেক রকম খারাপ সম্ভাবনার কথা পড়ে থাকি, কিন্তু আমি বেড়াতে গিয়ে স্থানীয় লোকেদের থেকে কখনও সমস্যায় পড়িনি, অযাচিতভাবেই কতবার তাঁদের থেকে উপদেশ পেয়েছি। অবশ্য এক আধবার হয়েছে, গাড়ির ড্রাইভার পছন্দ হয়নি। কথা থাকলেও আমাদের ইচ্ছেমতো ঘোরায় তাঁর আপত্তি থাকে। সেখানে বেড়ানোর স্বাধীনতাতেও খানিক ব্যাঘাত ঘটে। সৌভাগ্যক্রমে সেটি খুব কম। তাই খানিকটা সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়েই সিদ্ধান্ত নিই। তবে এটাও জানি, জীবনের এক আশ্চর্য মজা দেখার শখ থাকে। কবে কোথায় দাঁড় করিয়ে দেবে কে জানে। যাকে বলে কাহানিমে ট্যুইস্ট! সে যখন হবে, তখন ভাবব!
আরও পড়ুন: ঘুরতে ঘুরতে লাদাখ (তৃতীয় পর্ব)

বেশ কিছু পরে সিন্ধ নদীর পাশে এক ধাবায় দাঁড়ালাম। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। মেয়েটি এখানেই নেমে গেল, পাশেই গ্রামে ওর বাড়ি। ধাবাটির অবস্থান খুব সুন্দর, কিন্তু লোকজনের ভিড় ছিল না। জুনের শেষ দিক, ট্যুরিস্ট সিজন চলছে। কাশ্মীরের গোলমালের আশঙ্কায় বোধহয় কিছুটা ভাটা পড়েছে। আলুপরোটা, আচার আর দই খেলাম, আর বেশ খারাপ খেতে চা। পাশেই একটা দোকানে কাশ্মীরি শাল, জ্যাকেট ইত্যাদি সব বিক্রি করছিল। এখানেও খদ্দের ছিল না, প্রচুর ডাকাডাকি উপেক্ষা করতে পারলাম না। স্থানীয় মানুষদের রোজগার অনেকটাই ট্যুরিস্টদের ওপর নির্ভরশীল। কলকাতায় জুন মাসে দোকানে ভালো দেখতে দস্তানা (আহা! ছবি তুলতে হবে না!) খুঁজে পাওয়া লটারি পাওয়ার সমান। তাই দস্তানা কিনলাম এক জোড়া! আর একটা হালকা সোয়েটার। দস্তানার ছবি তোলা আর হয়ে ওঠেনি যদিও, বোধহয় আলসেমিতেই। খেয়ে উঠে আবার রওনা, এবার সোজা সোনমার্গ। নো ব্রেক।

সোনমার্গের উচ্চতা প্রায় নয় হাজার ফুট। চারদিকে তাকালেই বরফঢাকা পাহাড় চোখে পড়ে। সিন্ধ নালার ধারেই গড়ে উঠেছে সোনমার্গ। ভ্রমণার্থীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। কাছেই থেজস গ্লেসিয়ার, ঘোড়ায় বা হেঁটে গরমকালে বেশ কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। আর শীতকালে চারপাশ বরফে মোড়া, তার অন্যরকম আকর্ষণ। এবার সোনমার্গের আশপাশে ঘুরিনি, পাখির চোখ লাদাখ। যে হোটেলে ছিলাম, সেটা শ্রীনগর-লেহ মূল রাস্তার পাশেই। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি বেশ ঠান্ডা। হোটেলে থিতু হওয়ার পর চা খেয়ে একটু সামনে হাঁটাহাঁটি করলাম। একটু দূরে তাকালেই পাহাড়ের গায়ে পাইন, আলপাইন, সিডার চোখে পড়ে। দিনের আলো কমে এসেছে। এখানে লোকজন আছে দেখলাম। আমাদের ড্রাইভার খানিক ছটফট করছে। সে আজ ফিরে যাবে শ্রীনগর। লেহ থেকে যে ড্রাইভার আসছে, তাকে ডিউটি বুঝিয়ে সে বিদেয় নেবে। খানিক পরেই এক গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক ছেলে এসে হাজির। তার নাম রাকেশ, বয়স বেশি নয়, তিরিশের একটু বেশি। লেহ থেকে সে এসেছে। লাদাখেই জম্ম-কর্ম। পরের কয়েকটা দিন সে আমাদের চালক। আলাপ-পরিচয় হল, ফোন নম্বর বিনিময়ও। কালকের রাস্তা অনেকটা। সকালে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, সেটা জানাই ছিল। আর সারাদিনের এতটা দূরত্ব প্লেনে, গাড়িতে সফর, ক্লান্ত লাগছিল, তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমোতে গেলাম। কাঠের ঘর, ছোট কিন্তু আরামদায়ক!

সকালবেলাতেই গরমজলে ‘জয় মা’ বলে স্নান সেরে ফেলেছি। ব্রেকফাস্ট খেয়ে রেডি। আজকে জোজি লা পেরোব। সে পেরোলেই লাদাখের শুরু বলা যায়। হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়েই যাব। হোটেল থেকে বেরিয়ে অল্প কিছু দূর যেতেই চেকিং। এখানে ঠিক চেকপোস্ট না থাকলেও মাঝেমাঝেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে কাগজপত্র দেখে নেয়। খোঁজখবর নেয় কোথায় যাওয়া হচ্ছে। তারপর দেখি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে দিল। সামনে রাস্তায় পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর পড়ছে, রাস্তার জন্য পাথর ফাটাচ্ছে তাই। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ওপর থেকে সিন্ধ নদীটা খুব সুন্দর লাগছে। আর দেখা যাচ্ছে বালতাল। ওপর থেকে খেলনা বাড়িঘর মনে হচ্ছে। বালতাল থেকে অমরনাথে যাওয়া যায়, একদিনের পথ। শিবতীর্থ। সোনমার্গ থেকে অমরনাথ পিকও দেখা যায়।

শ্রীনগর-লেহ রাস্তার বেশ কিছুটা অংশ লাইন অফ কন্ট্রোলের খুব কাছ দিয়ে গেছে। সংগত কারণেই মিলিটারি টহল চলতেই থাকে। এটা এনএইচ ১, এই রাস্তা তৈরি হয় চিন যখন কারাকোরাম পাসে রাস্তা তৈরি করে, সেই সময়। ১৯৫০-এর দশকে। আগে শ্রীনগর থেকে লেহ যেতে ১৬ দিন লাগত, এই এনএইচ ১ হওয়ার পর সেটা দু’দিন লাগে এখন। ভাবা যায়! জোজিলা যখন শীতকালে ঢাকা থাকে বরফে, তখন এই রাস্তাও বন্ধ থাকে। এখন একটা টানেল তৈরির কাজ চলছে সারাবছর যাতায়াতের জন্য। মিলিটারি সৈন্য, তাদের রসদ সব এই রাস্তা (NH 1) ধরে যায়।

১৯৪৭-এ জোজিলায় কোনও ক্রমে ঘোড়া যাওয়ার রাস্তা ছিল! শ্রীনগর-লেহ রাস্তা ছিল ধূলিধূসর। নদী, ঝরনার ওপর কাঠের দুর্বল ব্রিজ। স্বাধীনতার সময় যখন দেশভাগ হয়, এই অঞ্চল রক্ষা করত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের দেশীয় সৈন্য। কয়েক মাস পরেই পাকিস্তান পুরো কাশ্মীর দখলের উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়ে। গিলগিট, বালতিস্তান, দ্রাস, কারগিল জোজিলা সম্পূর্ণ দখলে চলে যায়। লেহ দখল করতে পারেনি। কারগিল আর লেহ-এর মাঝে খালৎসে (Khaltse)-তে ছিল এক সেতু। সেই সেতু রক্ষা করতে থাকে রাজ্য বাহিনী। কিন্তু শ্রীনগর-লেহ এই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, জোজিলা হাতছাড়া হওয়ার জন্য। লেহ-তে চটজলদি কাজ চালানো গোছের এয়ারস্ট্রিপ বানানো হয় ১৯৪৮-এর মে মাসে। পাকিস্তান লেহ-এর দিকে এগোলে খালৎসের সেই ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে আটকানো হয়। জুন মাসে শ্রীনগর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লেহ-তে। খানিকটা শক্তি বাড়ে, কিন্তু লেহ তখনও বিচ্ছিন্ন আর শত্রু সামনেই। জোজিলা তখনও শত্রু দখলে। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বর মাসে জোজিলাকে মুক্ত করার দু’টো চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা এইসময় বেশ কিছু ব্রিজ বানান, রাস্তার উন্নতি ঘটান। এইসময় জেনারেল থিমাইয়া একদম অন্যরকম একটা প্ল্যান করেন, ট্যাঙ্ক ব্যবহারের চিন্তা করেন। মাস্টার স্ট্রোক! খুব গোপনে, দরকারে রাতের অন্ধকারে, কখনও কারফিউ জারি করে স্টুয়ার্ট ট্যাঙ্ক নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ অক্টোবর থেকেই জোজিলাতে প্রচুর বরফ পড়তে থাকে। আক্রমণের প্ল্যান পেছোনো হতে থাকে। এরপর ঠিক হয়, যেমনই আবহাওয়া থাকুক নভেম্বর মাসের ১ তারিখ হবে ‘অপারেশন বাইসন’। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাজিন্দার সিং দ্বিধাহীনভাবে প্রচণ্ড ঠান্ডায়, বরফপাতের মধ্যে জোজিলা পুনর্দখলের যুদ্ধ শুরু করেন। এত উচ্চতায় এইরকম আবহাওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্কের ব্যবহার পৃথিবীতে সর্বপ্রথম। শত্রুপক্ষ পুরোপুরি চমকে যায়। জোজিলা মুক্ত হয়।

নভেম্বরে তারপর ক্রমে ক্রমে মুক্ত হয় দ্রাস, কারগিলও। এই যুদ্ধে না জিতলে কাশ্মীর আর ভারতের অংশ থাকত না। এত সুন্দর একটা রাজ্য। কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ভারতের অন্য রাজ্যের মতো নয়, বুঝতে পারা যায়। সীমান্ত সমস্যা, প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা, ঝামেলার আশঙ্কায় দিন কাটে।

জোজিলা পেরোনোর উত্তেজনা ছিল তাই। সোনমার্গ থেকে জোজি লা খুব কাছে, প্রায় ১৫ কিমি। উচ্চতা প্রায় ১১৫৭৫ ফুট। উচ্চতা তত বেশি না হলেও বিপদসংকুল। কাশ্মীর থেকে লাদাখ যাওয়ার একমাত্র রাস্তা, পাথুরে, পাহাড়ের গা কেটেই বানানো। অসমতল রাস্তা। পাহাড়ের গা বেয়ে পাক খেয়ে খেয়ে উঠতে হয়। চারপাশ খুব রুক্ষ, গরমকালে বরফ অত বেশি ছিল না। রাস্তা কোথাও খুব সরু। চারপাশে পাহাড় ঝুঁকে আছে। অদম্য কালো পাথর। একদম ওপর থেকে বালতাল খুব সুন্দর দেখায়।

আমার যতদূর মনে পড়ছে একদম ওপরের অংশে রাস্তা দু’ভাগ হয়েছিল। খুব সরু সরু দু’টো ভাগ। একটা লেহ-এর দিকে, আর একটা নিচের দিকের কোন গ্রামে। ছবি তুলিনি তখন, গুগলেও তথ্য পাচ্ছি না। তাই যাচাই করতে পারছি না। একটু নেমে এসেই আর্মি ক্যাম্প। এখানে সবাই থামে, চা খায়। জোজিলা নিরাপদে পেরোনো গেছে, এটা খানিকটা তার প্রকাশ। গরম চা এখানে শরীরের উপকারেও লাগে। তবে এটাও বুঝেছি, ড্রাইভার বাবাজীবনই মধুসূদন। রাখলে রাখবেন, ফেললে ফেলবেন।

এরপর সামনের রাস্তা ভালো। পাশে বরফঢাকা প্রান্তর, গ্লেসিয়ার। এখানে বরফের ওপর কিছু স্নো স্পোর্টসের বন্দোবস্ত আছে। আমাদের গন্তব্য আরো অনেকটা এগিয়ে। ধা-বিমা। এক ছোট্ট গ্রাম। এগোনো যাক।
উল্লিখিত ছবি ছাড়া সব ছবিই লেখকের তোলা।