আলু নিয়ে আলুথালু

প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
এমন একটা ফসলের কথা কি আমরা জানি যাকে অনেক সময় পৃথিবীর মতো দেখায়? ভেতরটাও প্রায় পৃথিবীরই মতো— তিন ভাগ জল। ঝোলে, ঝালে, ভাজায় সবেতেই লাগে। অম্বলে লাগে কিনা জানি না, তবে মাছের টক যখন খেয়েছি তখন এর টক বা অম্বল উপাদেয় হয় কিনা রান্না বিশারদরা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
এলিট শ্রেণির মানুষজন এর ভাজাকে finger fry বলে একে কৌলিন্য দেন। উঠতি ছেলেমেয়েরা নিজেদের আকর্ষণ করার সময় ও এর নাম নেয়। এত ভনিতা দেখে বিরক্ত হবেন না। আলুর কথাই বলছি।
আরও পড়ুন: গোলপাতা চাষ ও গোল গুড় উৎপাদন হতে পারে সুন্দরবন উপকূলের বিকল্প কর্মসংস্থান

জন্ম প্রায় ১৮০০ বছর আগে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার পেরু আর বোলিভিয়াতে হলেও কীভাবে যেন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে পর্তুগিজ আর ওলন্দাজ বণিকদের হাত ধরে এদেশে চলে আসে। এর জন্য মাটি লাগে ঝুরঝুরে আর অনেকটা অভিমানী প্রেমিকার মনের মতো স্যাঁতসেঁতে। কিন্তু কান্নার নোনা জল একদম সহ্য করতে পারে না। মানে নোনা মাটি দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মাটি যেন জীবনে ঘা খেতে খেতে লড়ে যাওয়া মানুষের মতো শক্ত না হয়। কঠিন কোমলে মেশানো দোআঁশ মাটিতে নিজেকে সবথেকে ভালোভাবে মেলে ধরতে পারে তা।
এ কিন্তু বেশ আদুরে আর নরম সরম। বৃষ্টির জল তো অনেক দুর দু চার দিন আকাশে বেশি মেঘ থাকলে ধ্বসা রোগে ধ্বসে যেতে পারে। তাই লাগানোর আগে একে শোধন করে নিতে হয়। আর লাগানোর পর থেকেই এ দু’চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে চায়, তাই বীজ আলুর দু’টো চোখ রাখতেই হয়। জমির মাটি উঁচু করে ভেলি করে লাগাতে হয়। আর দুই ভেলির মাঝখানে জলসেচ দিতে হয়।
আবহাওয়া কেমন থাকলে আলু ভালো হয়? দীর্ঘ ঠান্ডা আবহাওয়া, শুকনো বাতাস, মেঘমুক্ত রোদ ঝলমলে পরিবেশ আলু চাষের জন্য সবথেকে ভালো। আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত আলু লাগানো হয়। উর্বর বেলে দোঁয়াশ থেকে পলি দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য সবথেকে ভালো। আলু চাষের জন্য জমির জলনিকাশি ব্যবস্থা ভালো থাকা দরকার।
আলু চাষের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রোগমুক্ত বীজ আলু উৎপাদন। এর জন্য আমাদের উত্তরের রাজ্যগুলির ওপর নির্ভর করতে হয়। অথচ পদ্ধতি মেনে চাষ করতে পারলে আমাদের রাজ্যেও বীজ আলু তৈরি করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: ‘সঙ্গোপনে অলোকরঞ্জনা’
বীজের জন্য আলু চাষের পদ্ধতি
ক) অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ভালোভাবে কল হওয়া রোগমুক্ত, পুষ্ট ১.৫-২ ইঞ্চি ব্যসের আলু ভালোভাবে শোধন করে জমিতে লাগাতে হবে।
খ) বীজ আলু কাটার সময় ১ শতাংশ পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট দ্রবণে একে প্রতিবার কাটার যন্ত্র ধুয়ে নিতে হবে।
গ) বীজ আলুর জমি খাওয়ার আলুর জমি থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে থাকা দরকার।
ঘ) ভালো জলনিকাশি ব্যবস্থা যুক্তি দোঁআশ মাটি বীজ আলুর জন্য ভালো। সেচের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ঙ) আলু তোলার দু’সপ্তাহ আগে গাছ কেটে দিতে হবে।
চ) আলু তোলার পর মাঝারি মাপের অক্ষত আলু ০.২ শতাংশ ছত্রাকনাশকে কিছু সময় ডুবিয়ে রেখে ছায়াতে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর নতুন বস্তাতে ভরে নিয়ে হিমঘরে রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: নবানে কার্তিক ও কার্তিকের কৃষি সম্পৃক্ততা

প্রকৃত আলু বীজ দুই ভাবে ব্যবহার করা যায়—
১) বীজতলায় বুনে সেখানেই বীজ আলু উৎপাদন করা।
২) বীজতলায় চারা তৈরি করে তা মূল জমিতে লাগিয়ে বীজ আলু ও খাওয়ার আলু উৎপাদন করা।
আলুকে অনেক সময় ‘আলুনি আলুনি’ মনে হলেও একে নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই চাষের এক নূতন দিক হলো প্রকৃত আলু বীজ True Potato Seed (TPS)-এর মাধ্যমে আলু চাষ। এতে ফলন বেশি হয় ও রোগ পোকার আক্রমণ কম হয়।
আগেই বলেছি মেঘলা আবহাওয়া আর বৃষ্টি হলে ধ্বসা রোগে আলুগাছ ধ্বসে যায়। তাই আকাশে দু-এক দিন মেঘ দেখলেই ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। একই ওষুধ ব্যবহার যা করে তিন-চারটি ছত্রাকনাশক যেমন মানকোজেব, মেটালাক্সিল, কার্বেন্ডাজিম, ব্লু কপার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে স্প্রে করতে হবে বৃষ্টি মুক্ত দিনে সকালবেলা বা বিকালবেলা।

এছাড়া ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ দেখা দিলে কাণ্ডের কাটা অংশ থেকে ঘন রস বেরোয়। এক্ষেত্রে প্ল্যাংটো মাইসিন ০.১৫ শতাংশ ভালো করে স্প্রে করতে হবে।
পোকার মধ্যে কাটুই পোকা হল আলুর প্রধান শত্রু। এর আক্রমণ বেশি হলে ক্লোরপাইরিফস দেড় শতাংশ প্রতি লিটার হিসাবে জলে গুলে স্প্রে করতে করতে হবে। এছাড়া জাব পোকা বা চোষি পোকার আক্রমণ দেখা দিলে ডাই মেথোয়েড প্রতি লিটার জলে ২ মিলি হিসাবে গুলে স্প্রে করতে হবে।
কখন মাঠ থেকে আলু তোলা উচিত? পাতার রং হলুদ হলে এবং আলুর ছাল পুরু হলে আলু কোদাল দিয়ে সাবধানে তুলতে হবে যাতে আলু না কেটে যায়। আলু তোলার ১০-১২ দিন আগে থেকে জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। জাত অনুযায়ী প্রতি বিঘাতে ২৫-৪০ কুইন্টাল আলু পাওয়া যায়।
শুনতে একটু অবাক লাগলেও ভালো লাগবে এটা জেনে যে, আলুতে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ ছাড়াও যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ আছে। এছাড়া আবার প্রোটিনও আছে, যা শরীর ভালো রাখার জন্য বেশ কার্যকরী। আলুতে প্রধানত প্রচুর পরিমাণে শর্করা থাকে, যা মানুষকে শক্তি জোগায়। তাই বলে ভাববেন না যে, শক্তিমান মানুষ আর আলু সমার্থক। ছোটবেলায় আমরা একটু গাবলু-গোবলু ছেলেদের ‘আলুভাতে’ বলে পেছনে লাগতাম। এতে বেশ একরকম নির্মল আনন্দ হত। এখনকার ছেলেরা কাউকে আলুভাতে বলে কি ক্ষ্যাপায়?

তাহলে একটু জেনে নিই যে, আলু নিয়ে এত আলোচনা তাতে কী কী থাকে? প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে ৭৭.৮ গ্রাম জল, ১৯.১ গ্রাম শর্করা, ২ গ্রাম প্রোটিন, ০.১ গ্রাম ফ্যাট, ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম আর যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ থাকে।
জেনে ভালো লাগতে পারে যে, বিজ্ঞানীরা পট্যাটো চিপস তৈরির জন্য ভিতরে কম জল থাকে এমন আলুর জাত ও আবিষ্কার করেছেন, যা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় চাষ হছে।
আলু কিন্তু মুক্ত হাওয়ায় বেশি দিন ভালো থাকে না। একে হিমঘরে সংরক্ষণ করতে হয়। সাধারণত পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং নব্বই শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় আলু প্রায় সাত আট মাস ভালো থাকে। আমাদের রাজ্যে হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলাগুলোতে খুব ভালো আলু চাষ হয়। এই সব জায়গায় অনেক হিমঘর দেখতে পাওয়া যায়। এখানে অনেক মানুষ কাজ পায়।

পড়তে পড়তে ক্লান্ত লাগছে? কী খাবেন বলুন? চা বা কফির সঙ্গে আলুর চপ? আলুর পকোড়া? পট্যাটো চিপস? ফিঙ্গার ফ্রাই? ঝটপট ভেবে নিয়ে নিজের পয়সায় ফটাফট খেয়ে ফেলুন।
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন কৃতী ছাত্র তথা গবেষক। বর্তমানে পঃবঃ রাজ্য সরকারের কৃষি দপ্তরের আধিকারিক পদে বৃত।
অসামান্য প্রস্তাবনা, ছবিগুলো খুব উপযোগী সংযোজন। আলু একটা সব্জি, আবার এর ফলও হয়, তার থেকে বীজও পাওয়া যায়। আলু গাছের পাতা দিয়ে দারুণ সুস্বাদু পদ রান্না করা যায়।
ফটোগুলো খুব সুন্দর.