৯৭ বছরে ঝাড়খণ্ডের ‘বাবুপাড়া’ রেল কলোনি ভোজুডির দুর্গাপুজো

রীনা ভৌমিক
প্যান্ডেলে পা দিতেই পা ঝমঝম করে উঠল। দীর্ঘ বাইশ বছর পর পায়ে মাটিতে দেখা। ওরা গল্প জুড়ে হুড়োহুড়ি লাগাল ‘আমাকে দেখো, আমাকে দেখো’ বলে। বেশ বুঝতে পারছিলাম গা আলো খুলছে। স্মৃতি অন্ধকারকে একপাশে সরিয়ে আলোকে ডেকে মাদুর পেতে দিচ্ছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মশাই বাতাবরণে ধূপের গন্ধ বিলাচ্ছেন, ‘…মহামায়া সনাতনী শক্তিরূপা গুণময়ী…’
আরও পড়ুন: ঝাড়খণ্ডের আটত্রিশ পঞ্চায়েত জুড়ে সিটি চন্দনকেয়ারির ওঝাদের সাবেকি দুর্গাপুজো
ভোজুডির প্রথম দুর্গাপুজো এবং প্রথম থেকেই শানদার ও জানদার পুজো এই লাইনপারের পুজো। সময়টা ইংরেজ আমলের শেষের দিকের। ভোজুডি রেল কলোনি গড়ে ওঠে দু’ভাগে। এক রেল এরিয়া। দ্বিতীয় পাবলিক। লাইনের পশ্চিমে বাবুপাড়া বা লাইনপার, সাহেব পাড়া ও মহুয়াখুলি। পূর্বে ছাতাটাঁড় নীচুবাজার ও গোরখাখুলি। লাইনপার বা বাবুপাড়া সম্পূর্ণ বাবু কালচারে দীক্ষিত ছিল। রেলের বাবু বা উঁচু পোস্টের মানুষজন এই পাড়ায় বসবাস করতেন। তাঁরা বেঙ্গলিক্লাব নামে এক ক্লাব কাম লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। বেঙ্গলিক্লাবই ১৯২৪ সালে বাবুপাড়ার দুর্গাপুজো শুরু করে। জানালেন রঞ্জিত পালিতদা। তিনি আরও জানান, “লাইনপারে যে পুজোকমিটি ছিল তাদের কাজও ভাগ ছিল। যদিও সবাই সব পুজোয় থাকতেন, তবে বাঙালি বাবুরা দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো ও কালীপুজোয় সক্রিয় থাকতেন। বিহারী বাবুরা জন্মাষ্টমী পুজোয় ও মাদ্রাসী বাবুরা গণেশ পুজোয়।”
আরও পড়ুন: ঝাড়খণ্ডের চন্দনকেয়ারির কুরমিটোলার দুর্গাপুজো

আমি ভোজুডিতে বড় হয়েছি। রেল কলোনি, বহতা পানি। কসমোপলিটন সিটির মতোই বহুজাতিক বহুভাষিক বহুমাত্রিক। আজও। বর্তমান পুজো কমিটিতে সক্রিয় আমার ছোটবেলার বন্ধু বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ও আশিস করের কাছে জানলাম আজও বাবুপাড়ার পুজো আগের মতোই ভব্য ও স্মার্ট করার আন্তরিক চেষ্টা করা হয়। আশিস বলল, ‘২০২৩-এ পুজোর একশো বছর হবে। খুব বড় মাপের উৎসবের কথা ভাবা হচ্ছে। নিমন্ত্রণ যাবে তোর কাছে। আসিস।”

বাবুপাড়ায় বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। প্রতিদিন ভোগ ও নবমীতে বালক ভোজন। বালক ভোজনের কথা মনে আসতেই ভুস করে ভেসে উঠল ছেলেবেলা। পুজোর ক’দিন আগে থেকেই স্কুল কামাই। মূর্তিকারদের সারাক্ষণ আমরা ছোটরা ঘিরে থাকি পঙ্গপালের মতো। বোধনে ঠাকুরের চোখের ফাইনাল টাচ দেখি বিস্ময়ে। বালক ভোজনে বড়মামা ঠেলে খেতে বসাত আমাদের। এমনও হত, পাশে বসে একজন ভিখারি খাচ্ছে। বড়মামা বলত, এটা নর-নারায়ণ সেবা বুঝলি। এভাবে খেলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে।

পুজোর চারদিন ঠাসা ঢাকের আওয়াজে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রে। দোকানপাটে। খাওয়া আর আড্ডায়। ওয়াল ম্যাগাজিনে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে। মন্টুমামা আর শিবাদার লা-জবাব ধুনুচি নাচে! ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যাচ্ছিলাম ফ্যান্টাসির দেশে। চোখজুড়ে ছায়া আর মায়ার লুকোচুরি। একটা ছবি টুপ করে ঢুকে পড়ল আচমকা। দেখি, কিশোরী আমি। নাকের ডগায় মস্ত এক পিম্পল। ভাই সরোজিত সেটা দেখিয়ে রাগাচ্ছে, ‘দিদি, ওটা তোর পুজোর বোনাস।’ সাঁওতাল নাচের ভিড়ে মিশে যাওয়া বিসর্জনের সন্ধ্যার কথা মনে পড়তেই, বুকে এক মিঠেল ব্যথা কুঁই-কুঁই করে উঠল!

কভার ছবিতে দুর্গার ছবিটি সম্রাট দাসের ক্যামেরায়