ইন্দ্রজিৎ মেঘ
ইতিহাসটা শতবর্ষ প্রাচীন। কিন্তু সেই ইতিহাস ক্ষয় পেতে পেতে হলদেটে হয়ে গেছে। বলছি, কলকাতার বো ব্যারাকের কথা। এককালের ঝলমলে কলকাতার এই বর্ধিষ্ণু জায়গাটি অনেক ফিকে হয়ে গেছে। এখন সেখানে ১৩২টি পরিবার থাকে। সেই পরিবারের সদস্যরা কি এবছর বড়দিন কিংবা নিউ ইয়ারের আনন্দ করছেন? শীতের বিকেলের রোমান্টিক রোদ গায়ে মেখে যখন বউবাজার থানার পিছন দিক দিয়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম, এই প্রশ্নটিই ছুড়ে দিয়েছিলাম পথচলতি একজনকে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই শীর্ণকায় মানুষটি বললেন, “সবই তো ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎই করোনা বাড়ছে। সঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে ওমিক্রন। তাই একটু ভয়ে আছি। কী থেকে যে কী হয়! তবে, দেখছেনই তো, কেমন সাজানো হয়েছে। রঙিন বেলুন, ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা, রঙিন আলো― কিছুই বাদ নেই। কিন্তু…”
আরও পড়ুন: সংক্রমণ আটকাতে ১৭টি মাইক্রো কন্টেনমেন্ট পয়েন্ট চিহ্নিত করল কলকাতা পুরসভা

কিন্তু মুকুটটা আছে, নেই সম্রাট। হ্যাঁ, মানুষটার ওই একটা ‘কিন্তু’-ই বছরের শেষদিনটাকে কেমন একটা সেপিয়া করে তুলল। এখনকার বো ব্যারাকেরও যেন এমন ধূসর অবস্থা। একটু এগোতেই চোখে পড়ল এক বিল্ডিংয়ের লাল ইট জিভ বের করে রয়েছে। এই ভঙ্গুর দশা দেখে মনটা যেন ছ্যাঁকা খেল। আমাকে একবার রামমোহন লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক শংকর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের জন্য এই ব্যারাক তৈরি হয়েছিল। তাহলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কেমন ছিল এই বো ব্যারাক? জানা যায়, এই বো ব্যারাক ওই সময় সেনাবাহিনীর জন্য নির্মিত গ্যারিসনের মেস। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধ শেষ হওয়ার পর কলকাতারই অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠীর দখলে যায় এই অঞ্চল। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই ‘অ্যাংলো পাড়া’ য় বসবাস করে আসছেন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই অ্যাংলো।
আরও পড়ুন: কলকাতার আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজে করোনা আক্রান্ত ২৭

এখানে যাঁরা থাকেন, সেই পরিবারগুলিকে ভাড়া দিতে হয় না। কারণ বিল্ডিংটি কলকাতা উন্নয়ন সংস্থা (কেআইটি)-র মালিকানাধীন। তবে সরকার এই ভবনটিকে অনিরাপদ এবং বিপজ্জনক ঘোষণা করেছে। যদিও এই জায়গায় একটি উঁচু বিল্ডিং গড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। যাইহোক, এই বো ব্যারাকে এবারের ক্রিসমাস উদ্যাপন শুরু হয়েছিল ২১ ডিসেম্বর থেকে। বেশ জমাটি সংগীত পরিবেশনা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল নৈশভোজের ব্যবস্থাও। তবে অতিরিক্ত ভিড় এড়াতে বিনামূল্যে ছিল না এই অনুষ্ঠান। তবুও ক্রিসমাসের স্বাদ নিতে বহু মানুষ সেখানে ঢুঁ মেরেছেন। আর আজও যে সেখানে লোকজন যে নেই, তা নয়। বরং পুলিশের অবিরাম মাইকিং― “বেশি ঘোরাঘুরি করবেন না। মাস্ক পরুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন”-এর মধ্যেও বছরের শেষদিনে ঘুরতে আসা মানুষগুলো বেশ উৎসাহী। মাথায় সান্তাটুপি পরা পূর্বা ঘোষ জানালেন, এখানে তিনি ২০১৫ সাল থেকে এই দিনটিতে এখানে আসছেন।
আরও পড়ুন: ‘সুস্থ থাকুক বাংলা, বজায় থাকুক শান্তি-সম্প্রীতি’, নতুন বছরের শুভেচ্ছা রাজ্যপালের

এখানকার রেসিডেন্টস সেক্রেটারি অ্যাঞ্জেলা গোবিন্দরাজ বলেছেন, “আমরা আমাদের এখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিছু কিছু দিন ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে যায়। ঠিক এই কারণেই ২১ ডিসেম্বর চার্জ ধার্য করতে হয়েছিল। আজ, বছরের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা সবাইকে ভিড় এড়াতে অনুরোধ করছি।” গতবছর করোনার কারণে এখানকার সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল ছিল। এবারের অনুষ্ঠান বাতিল হয়নি। তবে করোনা এই বছরের শেষে তার ঝোড়ো ব্যাটিং শুরু করছে। তাই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ বা উৎসাহে কিছু অংশে কমতে বাধ্য। যখন ফিরছি, বর্ষশেষের আলো আমাদের বিদায় জানাচ্ছে। আর পিছনে তখন বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা স্থিতদি। শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মানেকজি রুস্তমজি পার্সি ধর্মশালাও আমাদের আবার এখানে আসার জন্য যেন অনুরোধ জানাচ্ছে। এখানকার পার্সি খাবার খুবই প্রসিদ্ধ। বহু ভোজনরসিক মানুষ এখানে আসেন জিভের চাহিদা মেটাতে। নতুন বছরের নতুন অঙ্গীকার নিয়ে আবার আসা যাবে সেই খাবার চেখে দেখার জন্য। হ্যাপি নিউ ইয়ার সকলকে।
ছবি ডিকু ভট্টাচার্য