ড. অনির্বাণ ঘোষ
অতি সম্প্রতি আমরা গান্ধিজির হত্যার ৭৪ বছর অতিক্রম করলাম। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির বিড়লা হাউসে আততায়ী নাথুরাম গডসের গুলিতে জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধির মৃত্যু সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে এক অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এই অস্বাভাবিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবাসী বিহ্বল হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও এই ঘটনা ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। জাতীয় রাজনীতিতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন এই ঘটনার ঘোর নিন্দা করে এবং তাঁকে শ্রদ্ধা জানায়। কলকাতা এবং বাংলার বিভিন্ন জেলায় অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। ২ ফেব্রুয়ারি জি ডি বিড়লা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা গান্ধিজির স্মৃতিবিজড়িত ‘বিড়লা ভবন’কে জাতির উদ্দেশ্যে দান করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত সরকারে পক্ষ থেকে ১৩ দিনের জাতীয় শোক এবং ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধিজির স্মৃতিবিজড়িত সমস্ত জায়গার চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রীচক্রবর্তী রাজাগোপাল আচারী বারাকপুরে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে গঙ্গায় মহাত্মার চিতাভস্ম বিসর্জন দেন।
আরও পড়ুন: অগ্নিযুগের বিস্মৃত নায়ক: প্রদ্যোৎকুমার
গান্ধি হত্যার খবর পেয়ে পরদিনই অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি গান্ধিজির শেষ দর্শনলাভ এবং তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শ্রীশরৎচন্দ্র বসু এবং তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বিভাবতী বসু বিমানযোগে কলকাতা থেকে দিল্লি রওনা হন। শরৎচন্দ্র বসু শোকপ্রকাশ করে বলেন, জাতির জনকের মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। দিল্লিতে তিনি শোকসন্তপ্ত শ্রীযুক্ত রামদাস গান্ধি, শ্রীযুক্ত দেবদাস গান্ধির সঙ্গে দেখা করেন। বিড়লা ভবনে শ্রীমতী আভা গান্ধি ও শ্রীমতী মনু গান্ধির সঙ্গে দেখা করেন। গান্ধিজির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে দিল্লি থেকে আবার বিমানযোগে তাঁরা কলকাতায় ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন: নেতাজি রহস্য: ভারত ও বিশ্বের সমকালীন সময়

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত দল ফরওয়ার্ড ব্লকের মুখপত্র ফরওয়ার্ড ব্লক পত্রিকার সম্পাদিকা শ্রীযুক্তা লীলা রায় বলেন, “দেশের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনের সময়ই জাতি পিতৃহীন হইল। জাতির এই দঃখের দিনে দেশের সমুদয় প্রগতিশীলদলকে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইবে। ফরওয়ার্ড ব্লক সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ হইতে নিজেদের পক্ষ হইতে আমি মহাত্মা পরলোকগত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি।” বঙ্গীয় প্রাদেশিক ফরওয়ার্ড ব্লকের উদ্যোগে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় বউবাজার স্ট্রিটের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলে মহাত্মা গান্ধির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপনার্থে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করা হয় এবং সেই সভায় শ্রীমতী লীলা রায় সভাপতিত্ব করেন।
আরও পড়ুন: আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি: আজাদ হিন্দ অধ্যায়ের একটি নাম, অনেক অজানা কাহিনি

এছাড়াও কলকাতা কর্পোরেশনের ৫নং ওয়ার্ডের ফরওয়ার্ড ব্লক কমিটি এবং মধ্য কলকাতা ফরওয়ার্ড ব্লক জেলা কমিটির উদ্যোগে মহাত্মাজির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয় ও শোক প্রকাশ করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ফরওয়ার্ড ব্লকের জাতীয় সভাপতি সর্দ্দার শার্দ্দুল সিং কবিশের শোক প্রকাশ করে বলেন, “বীরের ন্যায় সকলযুগের শ্রেষ্ঠ মানব আত্মবিসর্জন করিয়াছেন। কিন্তু এ কথা আমরা ভুলিতে পারি না যে তাঁহার অমর আলোক শিখা কোনোদিন নির্ব্বাপিত হইবে না। চিরকাল তাহা ভাস্কর জ্যোতি বিকীর্ণ করিবে।”

গান্ধি-সুভাষ রাজনৈতিক বিবাদ সর্বজন বিদিত হলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনোদিন প্রভাব ফেলেনি, এই ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়। সেইসঙ্গে এটাও প্রাসঙ্গিক যে, ফরওয়ার্ড ব্লক রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেসের বিপরীত শিবিরে থাকলেও গান্ধিজির মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে দলীয় রাজনৈতিক সৌজন্যের ইতিবাচক নজির রাখতে সমর্থ হয়েছিল।
তথ্যসূত্র ১৯৪৮ সালে ১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর পত্রিকা