গোবিন্দরায় মন্দির, বালিসাহী- ভূঁঞাগড় (রামনগর- ২)

চিন্ময় দাশ
সন তারিখের হিসাবে, সাড়ে পাঁচশো বছরের একটি রাজবংশ। বর্তমানে ২৪/২৫তম প্রজন্মে পৌঁছেছে বংশটি। বংশের সপ্তম জমিদার কুলদেবতার জন্য একটি মন্দির আর বিশাল আকারের রাসমঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন। তা নিয়েই এবারের প্রতিবেদন।
দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি― দীর্ঘ সাড়ে চারশো বছর সময়কাল। মেদিনীপুর জেলার বহু এলাকাই ছিল কলিঙ্গ রাজাদের অধীন। বিশেষত অনঙ্গ ভীমদেবের সময়ে জেলার প্রায় পুরোটাই তাঁর অধিকারে ছিল। আজ যেখানে পর্যটনস্থল দিঘা, তার দূরেই ছিল বীরকুল নামে এক গ্রাম। সমুদ্রতীরের বীরকুলকে স্বাস্থ্যনিবাস হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এক ইংরেজ বড়লাট। নানান টানাপোড়েনে তা হয়ে ওঠেনি। পরে সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছে পুরো গ্রামটিই।
আরও পড়ুন: পার্বতীনাথ শিব মন্দির, উত্তর গোবিন্দনগর (থানা- দাসপুর, মেদিনীপুর)
মুঘল আমলে বীরকুল ছিল একটি পরগনা। তার করদ রাজা ছিলেন এক খণ্ডাইত সর্দার। সর্দার একবার কলিঙ্গরাজকে খাজনা পাঠানো বন্ধ করে দেন। সেসময় কলিঙ্গ রাজদরবারে ‘বিলাইতি ক্যানুনগো’ ছিলেন জনৈক ভূঁঞা বিশ্বনাথ দাস। কলিঙ্গরাজের আদেশে বীরকুল এসে, বিদ্রোহী সর্দারকে উৎখাত এবং নিজের জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
বিশ্বনাথের আদি নিবাস ছিল ওড়িশার কটক জেলার বালিবিশু গ্রামে। বাংলার বীরকুলে নতুন জমিদারি প্রতিষ্ঠা করে, নামকরণ করলেন― বালিসাহী। রাজধানীর নাম হল― ভূঁঞাগড়। সেখানে অট্টালিকা গড়ে, স্থায়ী বসবাস শুরু হল। পরে কলিঙ্গরাজ জমিদারি সনন্দ আর ‘চৌধুরী’ খেতাব দিয়েছিলেন বিশ্বনাথকে। তখন থেকে নতুন রাজবংশের পদবি হয়েছিল― ‘ভূঁঞা চৌধুরী কানুনগো বিলায়তি’।
আরও পড়ুন: ‘বাংলার শিবাজি’ শোভা সিংহের রঘুনাথ মন্দির, রাধানগর (ঘাটাল থানা, মেদিনীপুর)
আরও পরে, এই বংশের ষোড়শতম রাজা ভূঁঞা নীলাম্বর দাস মারাঠাশক্তি বা বর্গিবাহিনীর অধীনতা স্বীকার করে নেন। তাদের কাছ থেকে ‘বলিয়ার সিংহ’ খেতাব এবং বহু পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছিলেন তিনি। দু’টি কামানও ছিল অস্ত্রসম্ভারে। পরে ইংরেজ সরকারও কামান দু’টি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল ভূঁঞাবংশকে। রাজবাড়িতে এখনও আছে কামান দু’টি।
ভূঁঞাগড় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই শৈব ও শাক্ত― দুই মতে দেবারাধনা প্রচলিত ছিল পরিবারে। ছিল শিব ও কালীর দু’টি মন্দিরও। পরে চৈতন্যদেবের প্রচারিত প্রেমধর্মের প্রভাবে বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবসেবার প্রচলন হয় এই পরিবারে। ভূঁঞাগড়ে তখন সপ্তম প্রজন্মে জমিদার হয়েছেন শ্যামসুন্দর দাস।
আরও পড়ুন: রামজি মন্দির, রামবাগ (থানা- মহিষাদল, মেদিনীপুর)
একবার এক সন্ন্যাসী ঠাকুর তীর্থ পরিক্রমায় এসে জমিদারবাড়িতে উঠেছিলেন। বিদায়ের সময় নিজের আরাধ্য কৃষ্ণমূর্তিটি জমিদারের হাতে তুলে দিয়ে যান তিনি। সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজার প্রচলন হয় ভূঁঞাগড়ে। বিগ্রহের নামও হয়― সন্ন্যাসী মূর্তি। সেই মূর্তি চুরি হয়ে যাওয়ার পর, মন্দিরে গোবিন্দরায় জিউ নামের পাথরের শ্রীকৃষ্ণ ও পেতলের রাধারানির বিগ্রহ অধিষ্ঠিত আছেন।
গোবিন্দরায়ের মন্দিরটি দালান-রীতির। খিলান-রীতির তিন-দুয়ারি অলিন্দ আর এক-দুয়ারি গর্ভগৃহ নিয়ে একেবারে রাজকীয় গড়ন সেই মন্দিরের। তবে আমরা এখানে বিবরণ দেব দেবতার রাসমঞ্চটির। কেন-না, বিশাল আকারের নবরত্ন বিশিষ্ট সেই সৌধকে রাসমঞ্চ না বলে, রাসমন্দির বলাই সংগত।
আরও পড়ুন: শ্যামসুন্দর মন্দির, বালিপোতা (মেদিনীপুর কোতওয়ালি থানা)
জমিদারি উচ্ছেদের পর, সেবাপূজা আর উৎসবের আড়ম্বর আর নেই। রাস উৎসবটিও ম্লান হয়েছে। দেবতা রাসমঞ্চে আর আসেন না মন্দির থেকে। ফলে, রাসমঞ্চটি বহুকাল পরিত্যক্ত। অনাদরে অবহেলায় ভারী জীর্ণ দশা সেটির। তবে সৌধটির রাজকীয় গড়ন, তার রূপের বৈভব আজও বেশ অনুভব করা যায়।
রাসমঞ্চটির প্রথম বৈশিষ্ট্য এর ফুট পাঁচেক উচ্চতা। চারদিক জুড়ে প্রশস্ত প্রদক্ষিণ পথ। ভিতরে আবৃত অলিন্দ, চার দিক জুড়েই। মৃদঙ্গ আর খঞ্জনি বাজিয়ে নৃত্য করতেন কীর্তনিয়ার দল। প্রতিটি অলিন্দে তিনটি করে দ্বারপথ। অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান রীতিতে। ভিতরে উন্মুক্ত গর্ভগৃহ, তার সিলিং গম্বুজ রীতির। পাঁচটি রত্নের গড়ন চালা-রীতির। গর্ভগৃহের কার্নিশগুলি ভারী সুন্দর। তার বঙ্কিম ভাবটি সুন্দরী রমণীর আয়ত আঁখিপল্লবের মতো মনোরম।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের গড় হরিপুরে শতায়ু পূর্ণ করা রামচন্দ্র মন্দির
উল্লেখ করতে হয়, এর টেরাকোটা ফলকগুলির কথাও। সবই বড় আকারের মূর্তি। সমাবেশ হয়েছে প্রতিটি থামের দু’পাশে। বাদ্যকর-বাদ্যকরী, ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী ইত্যাদি নানাতর মোটিফ। বিস্ময়ে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু অবহেলায় অনাদরে সবই নষ্ট হয়ে চলেছে। না সেবাইত পরিবার, না পুরাতত্ত্ব দপ্তর― কারও উদ্যোগ নেই সৌধটিকে বাঁচাবার।
সাক্ষাৎকার
শ্রীঅরুণাশীষ দাস মহাপাত্র― বালিসাহী। শ্রীশিবাশীষ দাস মহাপাত্র― ভুবনেশ্বর। (টেলিফোন যোগে)
সমীক্ষাসঙ্গী
জ্যোতির্ময় খাটুয়া, ট্রাভেল এক্সপি মিডিয়া, কলকাতা।
পথ-নির্দেশ
কলকাতা থেকে দিঘা পথের উপরেই বালিসাহী। ট্রেনে এলে, হাওড়া বা খড়গপুর যে কোনও দিক থেকে রামনগর কিংবা দিঘায় নেমে, বালিসাহী আসা যায়।
ছবি লেখক