সম্পা গাঙ্গুলি
রানাঘাট নদিয়া জেলার একটি সুপ্রাচীন মহকুমা শহর। ১৮৬৪ সালে গঠিত হয়েছিল রানাঘাট পৌরসভা। তারও বছর দু’য়েক আগে রানাঘাট শহরের বুক চিরে বসেছিল রেলপথ। শিক্ষা, সংগীত, নাটকের পাশাপাশি খেলাধুলা এবং শরীরচর্চাতেও এই রানাঘাট শহর বহু সুনাম কুড়িয়েছে। রানাঘাটের প্রবীণ ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ক্রিকেটার (ও প্রখ্যাত ফোটোগ্রাফার) শ্রীপ্রণব মুখোপাধ্যায় (তিনুদা)-এর কাছ থেকে জানা যায় যে, ক্রিকেট ফুটবল ছাড়াও ভলিবল, সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স, জিমনাস্টিক্স, ভারোত্তোলন ইত্যাদি খেলাতেও বিশেষ নজির গড়েছিল রানাঘাট শহর। কিছুদিন আগে রানাঘাটের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ও সুলেখক শ্রীগৌতম চট্টোপাধ্যায় মহাশয় ‘পকেট হারকিউলিস’ (অর্থাৎ মনোহর আইচ) ও জয়দেব সাধুখাঁর সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই লেখা পড়েই আমি অনুপ্রাণিত হই এবং তাঁর সুপরামর্শেই আমি এই নিবন্ধটি লিখতে চেষ্টা করেছি। বলা বাহুল্য যে, এই বিষয়ে কোনও লিখিত উপাদান নেই। তাই আমার ভরসা নানা অভিজ্ঞজনের, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিকটাত্মীয়দের দেওয়া তথ্য। উল্লেখ্য যে, এই তথ্য সংগ্রহের যাবতীয় কৃতিত্ব শ্রীকল্যাণ গাঙ্গুলির।
আরও পড়ুন: এক বাঙালি ফুটবলপ্রেমীর শহিদের মৃত্যু: চল্লিশ বছর পরে কিছু কথা

এই রচনার উপজীব্য মূলত চারটি ধারায় বিভক্ত।
১. কুস্তি, মুগুর ও বারবেল ভাঁজা।
২. দেহসৌষ্ঠব এবং যোগ ব্যায়ামচর্চা
৩. ভারোত্তোলন
৪. জিমনাস্টিক্স, অ্যাক্রোব্যাটিক্স
১
যতদূর জানা যায়, রানাঘাট কলাকেন্দ্র বাড়ির অন্যতম কর্তা পাঁচুগোপাল কুণ্ডু (যাঁকে স্থানীয় বাসিন্দারা আদর করে ডাকতেন পাঁচু গুন্ডা নামে)। কারণ তখনকার দিনে সমগ্র রানাঘাটবাসীর কাছে পাঁচুগোপাল কুণ্ডু, ওরফে পাঁচুগুন্ডা ছিলেন ভরসাস্থল। সেই সময়ে রানাঘাট ছিল প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ আর জনবসতিও ছিল খুব কম। চোর-ডাকাত, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের অভাব ছিল না তখন। পাঁচুগোপাল কুণ্ডু ছিলেন অসীম শক্তির অধিকারী। তাঁর সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস কোনো দুর্বৃত্তের ও ছিল না। সেই সময় পাঁচুগোপাল কুণ্ডুর প্রচেষ্টায় একটা কুস্তি ও শরীরচর্চার আখড়া গড়ে ওঠে সম্ভবত ১৯২০ সাল নাগাদ। আখড়াটি ছিল বর্তমান রানাঘাটের ভাংড়াপাড়ার বকুলতলার মাঠের পূর্বদিকে। পাঁচুবাবু এবং সর্বশ্রী বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মুরারি পোদ্দার, জয়গোপাল বিশ্বাস, ফকিরচাঁদ মণ্ডল সহ এক ঝাঁক যুবশক্তি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যই স্বাধীনতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই শরীরচর্চা ও কুস্তির আখড়াটি গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরদের চোখ এড়াতে বারে বারে এই আখড়ার স্থান পরিবর্তন করেন শ্রীপাঁচুগোপাল কুণ্ডু। এটাই রানাঘাটের শরীরচর্চার প্রথম প্রয়াস।
আরও পড়ুন: ১৯৬২-র ৪ সেপ্টেম্বর: এশিয়ান গেমস ফুটবলে সোনা জয়ের রূপকথা পা দিল হীরক জয়ন্তীতে

এদের শরীরচর্চার মুখ্য উপকরণ ছিল বারবেল ও মুগুর ভাঁজা। তাঁর বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন নীলমণি প্রামাণিক। তিনিও এই শরীরচর্চার আখড়ায় অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এই নীলমণি প্রামাণিক (নীলুদা) ‘ম্যাসাজ’ বিষয়ে সুপরিচিত হন। এই নীলুদা ছিলেন অত্যন্ত রসিক মনের ও মানুষ।
এরপর হরিসভা লেনের উল্টোদিকে মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বাড়ির পেছনের মাঠে এই শরীরচর্চার আখড়াটি স্থানান্তরিত হয়। এই আখড়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করা। পাঁচুবাবু একজন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের চক্ষুশূল। অথচ ওনার পরিবারের কাছে তাঁর সম্পর্কে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। কী জানি, তাঁর পরিবারের এই ঔদাসীন্য হয়তো রানাঘাটের পক্ষে মানানসই!
২
রানাঘাটে দেহসৌষ্ঠব এবং যোগব্যায়ামচর্চা আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে শুরু হয়। যোগাচার্য শ্রীজয়গোপাল বিশ্বাস ‘রানাঘাট শারীরশিক্ষা কলেজ’ স্থাপন করেন শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া টাউন ক্লাবের টাউন ক্লাবের উল্টো দিকে। যদিও সেই শতায়ু প্রাচীন টাউন ক্লাবকে এখন আর চিনবার কোনও উপায় নেই, কারণ সেটা এখন বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তার সাইনবোর্ডটা বর্তমানে বহু কষ্টে দেখা যায়। (জায়গাটা চৌরঙ্গি ও ভাংড়াপাড়া মোড়ের ঠিক মাঝামাঝি)
আরও পড়ুন: মান্নাদা ৯৭: এক ফুটবল আত্মার জন্মদিনে কিছু স্মৃতিচারণ

শ্রীজয়গোপাল বিশ্বাসের গুরু পশ্চিমবঙ্গের সুবিখ্যাত ব্যায়ামচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষের পরামর্শেই এই আখড়ার পত্তন হয়েছিল। রানাঘাট শহরের তরুণদের ব্যায়াম ও শরীরচর্চা বিষয়ে প্রথম সর্বজনীন উদ্যোগ ছিল এটাই। তখনকার দিনে রানাঘাট শহরের প্রায় শতাধিক যুবক এই আখড়াকেই শরীরচর্চার আদর্শ স্থান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ পাল (ওরফে দেবু পাল) বডি বিল্ডিংয়ে তিনবার ‘রানাঘাটশ্রী’, তিনবার ‘নদিয়াশ্রী’ ও একবার ‘বঙ্গশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন। তাঁর দেহ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বিশ্বশ্রী মনতোষ রায় বিশ্বশ্রী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কলকাতায় তাঁর আখড়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর পিতার মৃত্যুতে পিতৃদত্ত ব্যবসার হাল ধরার জন্য মাত্র ২৩ বছর বয়সে তার সমস্ত প্রতিভা জলাঞ্জলি দিতে হয়। (প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে, তিনি ছিলেন রানাঘাটের প্রখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী হরিদাস পালের পুত্র) ।
তাঁর অন্যান্য কৃতী ছাত্রদের মধ্যে সর্বশ্রী বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, নীলমণি প্রামাণিক, যোগব্যায়ামবিদ হাফিজ আলি মণ্ডল, দুলাল ঘোষ, শান্তি গাঙ্গুলি (তিনবার রানাঘাটশ্রী)। তাঁর একমাত্র জীবিত শিষ্য সৌমেন (লাড্ডু) মুখার্জি তাঁর ৯০ বছর বয়সে এখনও সুস্থ নীরোগ ও নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করেন। জয়গোপাল বিশ্বাস তাঁর গুরু বিষ্ণুচরণ ঘোষের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় ৬ ঘণ্টা যোগ সহযোগে মাটির তলায় অবস্থান করে ‘যোগীরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: কলকাতায় প্রায় বিস্মৃত একটি খেলা এবং কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন

৩
রানাঘাটের ‘শরীর চর্চার ইতিহাস’ সমন্ধে যে নিবন্ধটি রচনা করছি, তার আগের দু’টি পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল কুস্তি, দেহসৌষ্ঠব এবং যোগব্যায়াম চর্চা। তিন ও চার পর্বের আলোচিত বিষয় হল ভারোত্তোলন, জিমনাস্টিক ও অ্যাক্রব্যাটিক্স।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রানাঘাট স্টেশনের পূর্ব পাড়ে ‘হার্ভে ইনস্টিটিউট’-এর বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ও তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে রানাঘাটের তরুণদের মধ্যে শরীরচর্চা ও ভারোত্তোলনে এক নতুন জোয়ার এনেছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষকে বহু কৃতী ছাত্র উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রখ্যাত ভারোত্তোলক জয়দেব সাধুখাঁ ও দীনবন্ধু ঘোষের (তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি) নাম উল্লেখ করতে হয়।
জয়দেব সাধুখাঁ তাঁর নিজের বিভাগে রাজ্যচ্যম্পিয়ন হন। বহুবার জাতীয় ভারোত্তোলক প্রতিযোগিতায় রাজ্যের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি রানাঘাট তথা সারাবাংলার গর্ব।
আরও পড়ুন: ১৯৭১-এর ২৪ আগস্ট: পঞ্চাশ বছর পরে ফিরে দেখা ভারতের এক অলৌকিক জয়

জয়দেব সাধুখাঁ একবার ‘বিশ্বশ্রী’ মনোহর আইচের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। সে-সময় মনোহর আইচের শো দেখবার জন্যে মাইকিং করা হয়েছিল বেশ কিছু দিন ধরে। রানাঘাট স্বাস্থ্যোন্নতির ময়দানে গ্রেটওরিয়েন্টাল সার্কাসের তাঁবুতে সেদিন প্রবল উত্তেজনা শুরু হয়। শ্রীআইচ ঘোষণা করেন, “এবার আমি সাড়ে সাতশো পাউন্ডের লৌহ গোলক উত্তোলন করব। এ খেলা আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শন করেছি। আমি ঘোষণা করছি, ‘এনি বডিবিল্ডার ইন এনি ওয়ে’।…” শ্রীআইচের মুখে এই কথা শুনে রানাঘাট হার্ভে ইনস্টিটিউটের জয়দেব সাধুখাঁ এগিয়ে এলেন। শ্রীআইচ উচ্চতায় বেশি ছিলেন না। তাই তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত গোলক তোলা জয়দেব সাধুখাঁর মতো লম্বা মানুষের কাছে প্রায় অসম্ভব ছিল। তিনি তাঁর জানুর ওপর হাত রেখে কাঁধ দিয়ে একঝটকায় সাড়ে সাতশো পাউন্ডের গোলক তুলে ফেলেছিলেন। চারিদিকে তখন তুমুল করতালিতে সার্কাসের তাঁবু ফেটে পড়ছে। সার্কাসের এক জোকার ও শ্রীআইচ তখন বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি কোনও চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেননি। কিন্তু দর্শকরা সে-কথা মানতে রাজি নন। দর্শকদের দাবি, শ্রীআইচ পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন। বিতর্ক যাইহোক, জয়দেববাবু সেদিন অগণিত দর্শকমণ্ডলীর সামনে সাড়ে সাতশো পাউন্ডের গোলক তুলেছিলেন, এটাই সত্য ঘটনা।
শ্রীজয়দেব সাধুখাঁ একজন আইকন। তিনি বহু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন ও পুরস্কার জিতেছিলেন। যেসব পুরস্কার জিতেছিলেন ও অংশগ্রহণ করেছিলেন, তার কিছুটা উল্লেখ করা হল।
আরও পড়ুন: পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি, মোহনবাগান এবং বাঙালির প্রথম অলিম্পিকে অংশগ্রহণ: ১৫ আগস্ট, ১৯২০

১) ১৯৭১-৭২ সালে ইন্টার ডিভিশনাল রেলওয়ে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।
২) তিনি ১৯৭৩ সালে অষ্টম ওয়েস্ট বেঙ্গল ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম স্থান লাভ করেন ইন্টার রেলওয়ে ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন।
৩) ইন্ডিয়ান ভারোত্তোলন ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৭৫ তিনি তৃতীয় স্থান ও ইন্টার রেলওয়ে ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন।
৪) ১৯৭৬-৭৭ সালে (সিনিয়র) বিভাগে ইন্টার রেলওয়ে ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন।
৫) ১৯৭২-১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি শুধু অংশগ্রহণই করেননি পাঁচবার প্রথম স্থান ও দু’বার দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন।
আরও পড়ুন: একশো বছর পূর্ণ প্রথম কলকাতা ডার্বির গোলের

৬) ন্যাশনাল গেমসে ১৯৭৯-৮০ সালে দু’বার তৃতীয় ও একবার দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হন।
৭) ১৯৮০ ইন্ডিয়ান ভারোত্তোলন ফেডারেশনে ইন্টারস্টেট ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
৮) ১৯৮২ সালে দিল্লিতে এশিয়ান গেমসে যোগদান করেছিলেন রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে।
৯) ১৯৮৭ সালে ইস্টার্ন রেলওয়ে স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন।
১০) দ্বিতীয় ইন্টার ডিভিশানাল ইস্টার্ন রেলওয়ে ইস্টার্ন রেলওয়ে ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন।
আমরা রানাঘাটবাসী হিসাবে শ্রীজয়দেব সাধুখাঁর জন্য গর্ব অনুভব করি। জয়দেব সাধুখাঁ যুগ যুগ ধরে রানাঘাটবাসীর কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন: শৈশবের হিরো, কৈশোরের গুরু
৪
রানাঘাট চর্চার ইতিহাসে এই শহরের জিমন্যাস্টরাও কোনও অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। বিম ব্যালান্স, আন ইভনবার, লং হর্স, ফ্লোর এক্সারসাইজ এই চারটি বিভাগেই তখনকার দিনে মেয়েদেরকে তালিম দেওয়া হত। ফকিরচাঁদ মণ্ডল মহাশয় পেশায় একজন মৎস্য ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রথমে তিনি সম পেশার কয়েক মানুষকে নিয়ে জিমন্যাস্টিক ও শরীরচর্চা অনুশীলন শুরু করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যে স্পোটিং ক্লাবের দ্বার উদ্ঘাটন করেছিলেন, সেখানেই অনুশীলন শুরু করেছিলেন ফকির চাঁদ মণ্ডল মহাশয়। পরবর্তীকালে তিনি বিম ব্যালান্স ও ফ্লোর এক্সারসাইজ-সহ বিভিন্ন শাখার জিমন্যস্টিক চর্চার নদিয়া জেলার পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। তিনি প্রধানত জিমনাস্টিক ও দেহসৌষ্ঠবের কলশো করে বেরাতেন অর্থ উপার্জনের জন্য। ‘কলকাতা বউবাজার ব্যায়াম সমিতি’র সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকায় জিমন্যস্টিকের ভারতের গর্ব অম্বালিকা মজুমদার সহ স্থানীয় খেলোয়াড়দের এখানে নিয়ে আসেন ও ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাঁর শিষ্যাদের মধ্যে রানাঘাটের চায়না পাল, মনিকা মুহুরী, ভারতী দাস বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আরও পড়ুন: অমল জলে অমল পুজো

চায়না পাল ছিলেন ফকির চাঁদ মণ্ডলের সুযোগ্য শিষ্যা। ১৯৭২ সালে তিনি কলকাতায় চারটি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিম ব্যালান্সে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। তাঁর মতো কিশোরীর পক্ষে প্রথম বারেই জাতীয় স্তরে সুযোগ পাওয়া খুব কম বড় কথা নয়। চায়না পাল মাত্র ১১ বছর বয়সে হরিয়ানায় ন্যাশনালে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে রাজ্যস্তরে চায়না পাল বিম ব্যালান্সে ব্রোঞ্জ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোর এক্সারসাইজেও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। সেই বছর ত্রিপুরাতে জাতীয় ক্রীড়া আসর অনুষ্ঠিত হলে চায়না পাল বাংলা দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলার মেয়েদের দল সেই সময় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে নজির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৫ সালে রাজ্য প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান শেষ হলে চায়না পাল তখন চারটি বিভাগেই খেলে প্রত্যেকটি ইভেন্টেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। সেই আসরে প্রথম দু’টি বিভাগে প্রথমস্থান অধিকার করেন এই ব্যায়াম সমিতিরই মেয়ে ভারতী দাস।

১৯৭৮ সালে রানাঘাট রাজ্য জিমন্যাস্টিক প্রতিযোগিতায় রজ্যের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন চায়না পাল। আবার ১৯৭৭ চণ্ডীগড় ন্যাশনালে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। এছাড়া গুজরাত ন্যাশনালেও তিনি রাজ্যের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৯৭৭ সালেই রূপনগরে জাতীয় গেমসে চায়না পাল সোনা জিতেছিলেন। ১৯৮০ সালে চায়না পাল শেষবারের মতো জাতীয় গেমসে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে এশিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি ‘বার’ থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে হাতে আঘাত পান। এই ঘটনার পর থেকেই চায়না পালের খেলার জীবন শেষ হয়ে যায়। চায়না পাল কৃতিত্বের জন্য চিরন্তন হয়ে থাকবেন।
তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার
কল্যাণ গাঙ্গুলি
অমৃত পত্রিকা
চায়না পাল
ছবি খোদ ক্রীড়াবিদ ও তাঁদের পরিবার সূত্রে প্রাপ্ত
গুরুত্বপূর্ণ লেখা ।