ছোটবেলার পুজো দেখতে যেতাম সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও চণ্ডীপুরে

কুমার দীপ
প্রায় তেতাল্লিশ বছরের পুরনো চোখ দিয়ে যখন পিছনে তাকাই, সরু ছিদ্র পথ দিয়ে সুড়ঙ্গের একেবারে গোড়ার দিকে, শৈশবের দৃশ্যগুলো কেমন অস্পষ্ট লাগে। অস্পষ্ট, কিন্তু যে-টুকু দেখতে পাই, মুগ্ধতার মায়া নিয়ে চেয়ে থাকি। বিশেষত, শৈশবের পুজো-পার্বণের দিনগুলোর কথা মনে হলে আনন্দে ঝিকমিক করে ওঠে মন। আর দুর্গা পূজা? সে-তো শৈশবের স্বার্থপরতাহীন দিনগুলোর এক অমেয় পুলক-বারতা নিয়ে হাজির হত, মনের তারে বেজে উঠত নানারঙের গান। এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে এলে বিবিধ বাদ্য-বাজনা নিয়ে বুকের ভেতরে সুর তোলে স্মৃতি। লুটোপুটি খায় মধুময় সেই দিনগুলি! আনমনেই গেয়ে উঠি— ‘সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি!’
যে-গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেই ভুরুলিয়া কিংবা তার পাশের গ্রাম নাগবাটি, দেউলদিয়া, কাঁচড়াহাটি, ব্রহ্মশাসন… এসব স্থানে দুর্গাপূজা হত না। পূজা দেখতে যেতে হত শ্যামনগর ও চণ্ডীপুরে। শ্যামনগর আমাদের সদর উপজেলা, আমার শৈশবে ছিল মহকুমা শহর। অবশ্য, শ্যামনগর সকলে যাকে জানেন, তার অধিকাংশ এলাকাই আসলে নকিপুর, থানা অফিস ছাড়া আর তেমন কোনও জায়গা শ্যামনগর নামে ছিল না; যদিও বর্তমানে শহরের প্রায় সমস্তটাই শ্যামনগর হিসেবে পরিচিত। তো, নকিপুরের হরিতলা মন্দিরের পুজোটাই আমাদের শৈশবের প্রধান দুর্গা-উৎসব ছিল। মন্দিরের ভেতরেই প্রতিমাগুলো; মাঝখানে দুর্গা, তাঁর মাথার এককোণে পাহাড়ের ছবির ভেতরে মহাদেবের মূর্তি প্রায় চোখেই পড়ে না। দু’পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, আর দুর্গার পায়ের কাছে বল্লমবিদ্ধ, রক্তাক্ত মহিষাসুর, বিশাল এক মহিষের কাটা ঘাড় চিরে বের হচ্ছে; দেখে শিউরে ওঠার মতো। একটু দূরে ঘোমটায় মোড়ানো শাড়ি জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভূতপ্রতিম কেউ। নিশ্চয় প্রথম দর্শনে মাকে প্রশ্ন করেছি— মা, ওটা কে? আর মা ভক্তিতে প্রণাম জানিয়ে বলেছেন— ওটা গণেশ ঠাকুরের কলাবউ।
আরও পড়ুন: আমার মা-টি, লালমাটির দেশের পুজো

কলাবউ! আমার বিস্ময় কাটাতে মা হয়তো বলেছেন— হ্যাঁ, কলাবউ। গণেশ ঠাকুরের সঙ্গে কলাগাছের বিয়ে হয়েছিল। ঠাকুরের সঙ্গে কলাগাছের বিয়ে! আরও কিছু প্রশ্ন, অনুমান করি, আমার মুখ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল। কয়েকবছর আগে আমার ছেলে যেমন আমাকে করেছিল। হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকে আমি আমার মায়ের ন্যাওটা ছিলাম। মায়ের আঁচল ধরেই সবখানে যেতাম। বাবার সঙ্গেও গেছি অনেক জায়গায়, তবে মায়ের তুলনায় সেটি অনুল্লেখ্যপ্রায়। হরিতলার পূজায় অনেক দোকান বসত। খুব লোভ হত অনেককিছু কেনার, কিন্তু দু-এক টাকার উপরে কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার মায়ের ছিল না বললেই চলে। হরিতলার পূজা দেখা শেষ হলে জমিদার বাড়ি রোড ধরে হেঁটে যেতাম আরেকটি পূজামণ্ডপে, সেখানকার পূজা অবশ্য খুব একটা জাঁকজমক ছিল না। কয়েকবছর পরে নকিপুরের বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে পূজা শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল বলতে যা-বোঝায়, ঠিক তা-নয়; এই বাড়িতেই বহুবছর আগের থেকে বিরাট আয়োজনে দুর্গাপূজা হত।
আরও পড়ুন: ঝাড়খণ্ডের চন্দনকেয়ারির কুরমিটোলার দুর্গাপুজো

বিখ্যাত জমিদার রায় বাহাদুর হরিচরণ রায়চৌধুরির এই বিরাট জমিদার বাড়িতে একসময় খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা হত বলে মা ও বাবার মুখ থেকে শুনেছি। আমার বাবা বিমল চন্দ্র বৈদ্য। ১৯৩০ সালে জন্মেছিলেন। ব্রিটিশ আমলের গল্প বলতেন। জমিদার হরিচরণবাবু ও তাঁর জমিদারির গল্প করতেন বেশ শ্লাঘার সঙ্গে। বিশেষ করে হরিচরণবাবুর মা নিস্তারিণী দেবীর অলৌকিক গুণাবলি ও স্বপ্নে সোনার টাকা প্রাপ্তির কিংবদন্তিগুলি মাঝেমধ্যেই বলতেন। দেশভাগের পরে, পাকিস্তান আমলে হরিচরণবাবুর ছেলেরা ভারতে চলে যান। যা-হোক, আমরা বেশ বড় হওয়ার পরে যখন বহুবছর পরে পুনরায় এখানে পূজা শুরু হলে গা-ছমছম করা সেই বিশাল বিল্ডিংয়ের ভেতরের কোনও কোনও কক্ষে প্রবেশের সুযোগ ও সাহস পেয়েছিলাম কিছুটা। নকিপুর ছাড়া আমার শৈশবের পূজা দেখার একটি জায়গার কথা মনে পড়ছে, চণ্ডীপুর। দোকানপাঠের জৌলুসশূন্য চণ্ডীপুরে মন টিকত না।
২.
যদিও শৈশব থেকেই শুনতে পেতাম, কিন্তু মহালয়ার আসল ভালোলাগাটি টের পেতাম মাধ্যমিক স্কুলের দিনগুলোতে। ভোর রাত্রে কে, কার আগে ঘুম থেকে উঠবে, কে কাকে ডেকে তুলবে… এরকম একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। কয়েকদিন আগের থেকেই বাবা স্মরণ করিয়ে দিতেন— অমুক দিন মহালয়া, বাবার হাতে প্রায়ই পঞ্জিকা থাকত। কেউ কেউ রেডিয়োর ব্যাটারি আছে কি না, খোঁজখবর নিত। ব্যাটারি আছে বলতে ব্যাটারিতে পাওয়ার আছে কি না, সেটাই বোঝানো হত। নতুন ব্যাটারি কেনার রেওয়াজ ছিল অনেকের ভেতরে। রেডিয়োতে খুব স্পষ্ট এবং ফুল সাউন্ড না দিতে পারলে মন ভরত না কারও। যাদের রেডিয়ো ছিল না, তারা রেডিয়ো আছে এমন বাড়িতে এসে বসত কিংবা অনতিদূর থেকে কান পাতত। বিশেষ করে সন্তোষ কোম্পানির রেডিয়ো যার ছিল, মহালয়ার ভোরে তার একটা আলাদা কদর ছিল। যেমন বড়, তেমনি দরাজ তার শব্দ। আমরা কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলতাম— সন্তোষ কোম্পানির বাক্স। তিনবার শঙ্খধ্বনি শেষে যখন বীরেন ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শুরু হত, একেবারে পিনপতন নীরবতা। অধিকাংশ মানুষের জন্য বোঝাবুঝির কোনও বিষয় ছিল না, বীরেন ভদ্রের অতুলনীয় কণ্ঠ আর তার সঙ্গে বিখ্যাত সব শিল্পীদের সংগীত নিবেদন এক অব্যাখ্যেয় ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি করত সকলের মনে। আর চণ্ডীপাঠ শেষ হতেই আমাদের ভেতরে পুজো পুজো ভাব তৈরি হত। তবে একটি বিষয় স্বীকার করি, মহালয়া বলে যেটাকে জানতাম, পরে জেনেছি— সেটা আসলে মহিষাসুরমর্দিনী; মহালয়ার মূল তাৎপর্য, শাস্ত্রমতে, পিতৃতর্পণ— প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ।

আরেকটি কথা, আকাশবাণী কলকাতা এমনিতেই তখন আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল। পূজায় কোন শিল্পী, কী গান উপহার দিচ্ছেন, এটাও একটা আনন্দ-অনুষঙ্গ বটে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীদের গানে কান অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। একবার প্রিয় নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীর কণ্ঠে বেজে উঠল— ‘পুজো এলো, এলো পুজো, জয় দুর্গা বল; ড্যাম কুড় ড্যাম কুড় ঢাক বাজাবি চল’। ভিন্ন কিছু পেয়ে কী আনন্দ আমাদের! হ্যাঁ, এই কথাটিও বলে রাখি, আমাদের যেখানে বাড়ি, সেখান থেকে কলকাতা দূরদর্শন ও আকাশবাণীই ভালো শোনা যেত। ঢাকার টিভি চ্যানেলে ছবিই আসত না প্রায়। ফলে গান-সিনেমা দু’টো ক্ষেত্রেই আমাদের এলাকার মানুষের বেড়ে ওঠাটা কলকাতাকেন্দ্রিক। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম উভয়দেরই অভিন্ন অবস্থা। আমার এক প্রিয় অগ্রজ বাচ্চুভাইকে দেখতাম, সর্বক্ষণ রেডিয়ো হাতে, আকাশবাণী বিবিধ ভারতী কানে; ভারতীয় গানের অনেক খবরই তার কাছে পাওয়া যেত। তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যেত ক্রিকেটের খবর। তখন তাকে ক্রিকেটের এনসাইক্লোপিডিয়া মনে হত আমার।