বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত আর ভারী জীর্ণ কেশপুর বাদাড় গ্রামের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির

চিন্ময় দাশ
রূপনারায়ণ, শিলাবতী আর কংসাবতী— তিন নদীর জলধারায় উর্বরা ভূমি গড়ে উঠেছিল ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনা, পাঁশকুড়া, ডেবরা আর কেশপুর থানাজুড়ে। অন্যান্য কৃষিজ সম্পদ তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল নীল আর রেশমের উৎপাদন। উন্নত ব্যবস্থা ছিল পণ্য বিপণনেরও। তিনটি নদীর জলপথ তো ছিলই। তাছাড়াও, বাদশাহী সড়ক, দ্বারীর জাঙ্গাল, আর নন্দ কাপাসিয়ার জাঙ্গাল— তিন-তিনটি প্রাচীন রাজপথ প্রসারিত ছিল জেলার উপর দিয়ে। তাতে বাণিজ্যের সুবিধা হত ভারি।
আরও পড়ুন: অমল আলোয় ফুটবলার অমল গুপ্ত: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

পণ্যের উৎপাদন আর উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য পরিবহণ— দুই উপাদানই বর্তমান ছিল সেসময়। তারই ফলশ্রুতি হল বিদেশি বণিকদের আগমন। সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে, বিদেশি বণিকেরাও এসে উপস্থিত হয়েছিল এলাকায়। একে একে আর্মেনিয়ান, ফরাসি, ওলন্দাজ, আর সবশেষে ইংরেজ বণিকের দল এসে ঘাঁটি গেডে় বসে গিয়েছিল এই এলকায়। বিদেশি বণিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় বহু উদ্যমী পরিবারও। স্থানীয় মানুষেরা মুখ্যত শামিল হয়েছিলেন রেশমের ব্যবসায়। রেশমের ব্যবসা থেকে বহু পরিবার ধনী হয়ে উঠেছিল এক সময়।
কেশপুর থানার বাদাড় গ্রাম। কংসাবতীর একেবারে তীর ঘেঁষে অবস্থান গ্রামটির। সেখানে বসত ছিল ‘করণ’ পদবির একটি জমিদার পরিবারের। মেদিনীপুরের জমিদার কর্ণগড়ের রাজাদের অধীনে পত্তনীদার ছিলেন তাঁরা। এই জমিদার-বংশটি সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছু জানা যায় না। বহুকালপূর্বে তাঁরা বাদাড় গ্রামের বসত তুলে নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। করণ পরিবারটি সম্পর্কে কোনও সূত্রই আর বাদাড় গ্রামে বর্তমান নাই।
আরও পড়ুন: সতীপীঠ দেবী বর্গভীমা

ভারী সূক্ষ্ম একটি সূত্রের সন্ধান আমরা পেয়েছি একটি পুস্তিকায়। মেদিনীপুর জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে অনেকে কাজ করেছেন। তাঁদের বিবরণে মেদিনীপুর জেলার এই পূর্ব এলাকার স্থাপত্য এবং অর্থনীতির বহু উপাদান পাওয়া যায়। তেমনই একটি গ্রন্থ— ‘সূত্রধর শিল্প: দাসপুর’। লেখক ড. ত্রিপুরা বসু। তাঁর বিবরণে করণ পরিবারটি সম্পর্কে সামান্য উল্লেখ পাওয়া যায়। একের পর এক মন্দির গড়ে উঠবার পিছনে, স্থানীয় ধনী পরিবার বা ব্যক্তিদের অবদান সম্পর্কে পৃথক একটি অধ্যায় আছে তাঁর গ্রন্থে। অধ্যায়টির নাম— জমিদারি অনুপ্রেরণা। বর্ধিষ্ণুদের পৃষ্ঠপোষতা পেয়ে মন্দির নির্মাণ এবং কাঠখোদাই কাজে সে-সময়ের সূত্রধরেরা যে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, নাম-ধাম সহ তার উল্লেখ করেছেন তিনি। করণ পরিবারটি সম্পর্কেও উল্লেখ আছে সেখানে। তিনি বলেছেন— “দাসপুর সদরের চৌধুরী, সিংহ, পাল, নন্দী… লাওদার বালিয়াল ইত্যাদি বিত্তশালী পরিবারগুলির অনুপ্রেরণাতেই দাসপুরের সূত্রধর শিল্পীরা তাদের মৃত্তিকা-কাঠখোদাই শিল্পে উৎকর্ষতা দেখিয়েছেন। পার্শ্ববর্তী কেশপুর থানার গোপীনাথপুরের করণ, ডেবরা থানার চন্দ্রামেড় গ্রামের চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি পরিবারের দাক্ষিণ্যও পেয়েছেন দাসপুরের শিল্পীরা।” (গোপীনাথপুর আর বাদাড় একেবারে গা-লাগোয়া দু’টি গ্রাম। মন্দিরটি বাদাড় গ্রামে, করণদের বসবাস ছিল গোপীনাথপুরে।)
আরও পড়ুন: খড়দহে নিত্যানন্দ, জাহ্নবাদেবী ও বীরভদ্রের কথা

যাক এবার আমরা মন্দিরের কথায় ফিরি। বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত আর ভারী জীর্ণ এই সৌধটি। ঘন ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা। মন্দিরের দেওয়ালে ২টি জীর্ণ ফলকের সন্ধান পেয়েছি আমরা। ১. বামদিকের ফলকের বয়ান— “শ্রীশ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ জীউ/ সেবাইত রাধামাধব করণ/ শ্রীগোপালচন্দ্র দে/ মিস্ত্রি সাং দাসপুর”। ২. মন্দিরের ডান দিকের দেওয়ালের ফলকটি ছিল ৩ লাইনে লেখা। তার প্রথম ২টি লাইন সম্পূর্ণ অস্পষ্ট, উদ্ধারের অতীত। শেষ লাইনে পাওয়া যায়— “শকাব্দা ১৮১২ “। ফলক দু’টি থেকে জানা গেল— জনৈক রাধামাধব করণ ইং ১৮৯০ সালে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কারিগর ছিলেন দাসপুর থানার গোপালচন্দ্র দে। বাস্তব ঘটনা হল, মন্দির নির্মাণের দু-তিন দশকের মধ্যেই করণ বংশটি গ্রামের বাস তুলে নিয়ে, মেদিনীপুর জেলা শহরে উঠে যান। সেসময় মন্দির-সহ কিছু সিদ্ধ-দেবোত্তর সম্পত্তি একটি পরিবারকে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: প্রাচীনতমের বিচারে কাঁথি মহকুমায় তৃতীয় ও পটাশপুর থানায় সর্বপ্রাচীন কিশোররায় মন্দির

শোনা যায়, একসময় মন্দিরে পুরোহিত আসা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তখন ৩ বিঘা সম্পত্তি সহ দেবতার বিগ্রহটি কংসাবতী নদীর অপর পারে এক ব্রাহ্মণকে দান করে দেওয়া হয়। তখন থেকে মন্দিরটি পরিত্যক্ত। সেসময় থেকেই মৃত্যুর পরোয়ানা সাঁটা হয়ে গিয়েছে সৌধটির কপালে। উঁচু পাদপীঠের উপর নির্মিত পূর্বমুখী মন্দির। সামনে কলাগেছ্যা রীতির থাম। খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ অতিক্রম করে, টানা অলিন্দ। তার পিছনের এক-দ্বারী গর্ভগৃহটি বেশ প্রশস্ত।

মন্দিরটি জীর্ণ আর ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা হলেও এখনও টেরাকোটা অলংকরণের কিছু চিহ্ন দেখা যায়। ফলকগুলি আছে ৩টি সারিতে— সরলরৈখিক কার্নিশের নীচ বরাবর এক সারি। আর, দু’দিকের কোনাচের গায়ে খাড়াখাড়ি দুই সারি। ছোট ছোট খোপে টেরাকোটা ফলক বসানো হয়েছিল। তবে, বর্তমানে মন্দির পরিত্যক্ত। এলাকাটিও প্রায় জনহীন। ছদ্মবেশী পুরাপ্রেমী আর অসাধু ব্যক্তিদের হাতে ফলকগুলি দ্রুত অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। বুনো ঝোপঝাড় আর লতাপাতার সবুজ আস্তরণের আড়াল ভেদ করে দৃষ্টি ফেললে, বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। মন্দিরের গায়ের উৎকৃষ্ট পঙ্খ-এর পলেস্তারার প্রলেপ আজও অমলিন। মসৃণ আর উজ্জ্বল দেওয়ালগুলি আটকে রেখে দেয় মুগ্ধ দর্শককে। আরও উল্লেখ করতে হয় গর্ভগৃহের দরজাটির কথা। তার কাঠের পাল্লাটি ভারি অলংকৃত। পৌরাণিক কত কাহিনি মূর্ত হয় উঠেছে বাটালির নিপুণ ঘায়ে। সেদিনের মন্দিরশিল্পীরা ইট-পাথরে সৌধ গড়ার পাশাপাশি, দারুতক্ষণ কাজেও কত সুনিপুণ ও দক্ষ ছিলেন, ছোট হলেও, তার উজ্জ্বল নমুনা অনাদরে মৃত্যুর দিন গুনছে এখানে।
সাক্ষাৎকার
শ্রীনীরদ বরণ ঘোড়াই— পাকুড়িয়া।
সহযোগিতা ও সমীক্ষাসঙ্গী
মাননীয় শ্রীমহাদেব সামন্ত, প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক— বার্জ টাউন, মেদিনীপুর শহর।
পথ-নির্দেশ
৬নং জাতীয় সড়ক মুম্বই রোডের ডেবরা বাজার। সেখান থেকে উত্তরে খানামোহন। এবার কাঁসাই নদী পার হলেই, বাদাড় গ্রাম। কিংবা, জেলা শহর মেদিনীপুর থেকেও যাওয়া যাবে। ঘোষডিহাগামী বাসে মুক্তিকেন্দ্র। সেখানে নেমে, নদীর পাড় বরাবর ৪ কিমি পার হলে বাদাড়।
ছবি লেখক