অন্য মনে, অন্য খাতায় আলোর আখর

মঞ্জিস রায়
বুবুন দাঁড়িয়ে আছে দোতলার বারান্দায় একা। রাজস্থানের হেমন্তকাল। বাতাসে হিমেল আমেজ। পাতা ঝরছে স্কুলের কোয়ার্টারসের লনে, কার্নিশে, রাস্তায়। রোদ চলে গেছে কখন। চোখের পলকে যেন একটা দিন শেষ। এই প্রত্যন্ত জায়গায় তো মনখারাপ, হতাশা আরও বেশি চেপে বসে। এখানকার হেমন্তের সন্ধ্যা যেন আরও আরও ভৌতিক হয়ে নেমে আসে খাতার পাতা জুড়ে। তাছাড়া ওর তো কোনও বন্ধুই নেই এখানে। মোটকথা, মানসিক সমস্যা থাকলে সে আমাদের সমাজে অযাচিত। সবার চোখ দিয়ে না দেখলে, সবার মতো না ভাবলে, কেইবা তার সঙ্গে মেশে, কেইবা দলে নেয়। এই স্কুল কোয়ার্টারস নিয়ে গড়ে ওঠা পাঁচিলঘেরা এলাকায় নিজেকে আগন্তুক মনে হয় ওর। দু’দিন পরেই দিওয়ালি। আলো দিয়ে সাজবে সমস্ত ব্যালকনি, লন। বাজির শব্দে গমগম করবে চারদিক। ক্লাস ফাইভের বুবুন বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আলো দেখবে প্রত্যেকবারের মতো। কিন্তু সে যে বাজিকে, শব্দবাজিকে সবসময় প্রচণ্ড ভয় পায়। ওপর থেকে শব্দ শুনতে পেলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। কানে হাত চেপে, চোখ মুখ কুঁচকে কাঁপতে কাঁপতে একটু একটু করে পিছিয়ে আসে ও। যেন সমস্ত আওয়াজগুলো একসঙ্গে তাড়া করতে আসে। খেলার মাঠে বুবুনের বয়সি অন্যরা বা একটু বড়রা তখন মেতে থাকে কালীপটকা আর চকোলেটবোমের মতো শব্দবাজির মৌতাতে। বুবুনের দিওয়ালি যতটা না আলোর আনন্দ নিয়ে আসে, তার চেয়েও বেশি নিয়ে আসে ভয়, শব্দের ভয় এঁকে দেয় খাতায়। মাথা ব্যথা করে, তখন কিচ্ছু ভালো লাগে না। সবকিছু মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যায়। অন্যরকম দেখায় চারদিক। রেশ থেকে যায় আওয়াজ থেমে যাওয়ার পরেও।
সবাই ওকে ডাকে, নানান কথা বলে ‘উৎসাহিত’ করার চেষ্টা করে। কখনও আবার ওর ভয়, ভীতি, আতঙ্ক নিয়ে মশকরা করে। একটু বড় যারা, তারা আবার নিজেদের মধ্যে প্রশ্ন তোলে এই ছোট্ট ছেলেটার মানসিক ভারসাম্য, এমনকী ‘পৌরুষ’ নিয়েও। তাই ওইদিন বারান্দায়ও বেশিক্ষণ টিকতে পারেনা বুবুন। নিচে যাওয়া তো দূরের কথা। এসব শৈশবের ছবি। বেশ কয়েক বছরের পুরনো। কিন্তু এখনও ফ্লাশব্যাক মোডে সাদাকালোয় স্পষ্ট ভেসে ওঠে আজকের বুবুনের চোখে।
আরও পড়ুন: বঙ্গদেশে চ কালিকা

শ্যামাপূজা বা কালীপুজোর আলোয় জেগে ওঠে কলকাতা। বাতাসে ছাতিমের গন্ধ মিলিয়ে যায়নি। পাড়ায় কোনও এক কালীপুজোর প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে ‘‘জানি জুঁই মালতী হায়, কত গন্ধ যে ছড়ায়…”। বাজি ফাটার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এদিক-সেদিক থেকে। রকেটের ফুলকিও দেখা যাচ্ছে। আলো দিয়ে সাজিয়েছে কোনও বারান্দা। তবুও এত তাড়াতাড়ি সন্ধে নামলে কেন যেন মনখারাপ হয়। আরও একটা দিন শেষ। কত কিছু করার, কত জায়গায় পৌঁছবার ছিল, কিন্তু কই। বসে ভাবতে ভাবতেই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ কোথা দিয়ে কেটে গেল। এখন হেমন্ত, তারপরেই শীত। এভাবেই চোখের পলকে বছর ঘুরে চলে আসবে আরও একটা হেমন্ত। সময়টাকে বড্ড ছোট মনে হয়। উৎসবের মরশুমের একেবারে শেষের দিকের এই উৎসবে ঝরে পড়ার আগে শেষবারের মতো গাছকে আঁকড়ে ধরে হলুদ পাতা। একটু উষ্ণতা ভাগ করে নেয় শীতের আগে। হয়তো কিছু বলতে গিয়েও কথা হারিয়ে ফেলে। তারাগুলো নির্বাক দেখে যায় দৃশ্যটা। দূরে কোথাও ঝরে যায় কাশফুল। শেষ আলোটুকু দেখিয়ে নিভে যাবে আকাশপ্রদীপ। তারারা আত্মগোপন করবে শীতঘুমে। অন্ধকারে কোনও নাম না জানা পুকুর কিংবা নদীর জলে একা একাই ভেসে উঠবে কালীমূর্তির কাঠামো। হাতড়ে বেড়াবে খড়্গ, মুণ্ডমালা। সাঁতার কাটতে কাটতে মিলিয়ে যাবে জলে। শিরশিরে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপবে জল। তারপর কুয়াশা এসে ক্ষেত, ঘাসজমি, রেললাইনে ঢেলে দেবে অপার শূন্যতা।
এখন কলকাতায় থাকে বুবুন। অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। পাড়ার রিকশা স্ট্যান্ডেই এই কয়েকবছর ধরে একটা ছোট্ট করে পুজো হয়। কত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটোছুটি করে প্যান্ডেলের সামনে। সবার মুখে হাসি। খাতায় জমা হয়ে থাকে এই উষ্ণতা। দুর্গাপুজোর মতো অত জাঁকজমক এ পুজোয় নেই কিন্তু এই পুজোয়ও সবাই মেতে ওঠে। ছোট ছোট করে আরও অনেক পুজো আয়োজন করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা। দুর্গাপুজো সবার উৎসব হলেও এত আয়োজন করা সব মানুষের পক্ষে সহজ নয়।
আসলে বুবুনের পরিবারে পুজো আচ্চার সেভাবে চল নেই। যা পুজো সব বাইরে থেকেই দেখা, আর কিছুটা বড়দের মুখে বা বই পড়ে জানা। মা কালীর মূর্তির মধ্যে কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব থাকে। কিছুটা রাগী মনে হয় বুবুনের চোখে। মনে হয় যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এক্ষুনি ঝড় উঠবে চারদিকে। আরও ভয়ংকর দেখাবে মা কালীকে। কোনও নদীর ধারে জঙ্গলঘেরা কালীমন্দিরের কথা পড়েছে, অনেকের কাছে শুনেছে। সেখানে ‘অলৌকিক’ বা ভয়ংকর কিছু ঘটে, অথবা ডাকাত, গুন্ডা বদমায়েশরা লুকিয়ে থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি কালীপুজোর সঙ্গে এসবেরও কোনও সম্পর্ক আছে? ভালো না খারাপ, সৃষ্টি না ধ্বংস, আলো না অন্ধকার, পার্থিব না অলৌকিক, আনন্দ না ভয়— সবকিছুর মধ্যে একটা প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয় তখন। ছোটবেলায় ভূতচতুর্দশী ব্যাপারটাও খুব অদ্ভুত লাগত বুবুনের। কিছুটা মজা, কিছুটা ভয়ের। মনে হত, ওই সময় হয়ত ভূতেরা জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভয়ও করত রাত বাড়লে। কিছুটা পরে ছোড়দাদুর থেকে শুনেছিল যে, এই সময়েই মৃত ব্যক্তিরা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আসে। তাই কার্তিক মাসে তাদের পথ দেখাতেই আকাশপ্রদীপ জ্বালানো হয়। এই বিষয়টা বুবুনের খুব ভালো লাগে, হলই বা মনগড়া কল্পনা।
কলকাতায় আলোর উৎসব বা উৎসবের আলোও কিছুটা অন্যরকম। এর মধ্যে কয়েকটা কালীপুজোতে ফুলঝুরি, রংমশাল জ্বালিয়ে দেখেছে। বাজির চোখ ঝলসানো আলোর পর যখন চারদিকটা অন্ধকার দেখায়, সেই ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগে ওর। তবে বাজির ধোঁয়ায় কিছুটা কষ্টও হয়। শব্দবাজিকে আগের মতো ভয় পায় না এখন। তবে ভালোও বাসে না। ক্যাপও ফাটায়নি কোনওদিন। কালীপুজোর প্যান্ডেলে কোনও কোনওবার ঠাকুর দেখতে গিয়েছে বুবুন। হয়তো কোনওবার ভালোমন্দ খেয়েছে, স্কুলের কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে। রাজস্থানের দিওয়ালির চেয়ে কলকাতার কালীপুজোই ওর খাতায় বেশি ছাপ ফেলে। কালীপুজোর কিছুদিন পরেই স্কুল খুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার পথে সঙ্গে থাকে অন্য রোদ্দুর। বিকেল পাওয়া যায় না বাড়ি ফিরে। কালীপুজোর সব আলো নিভে গেলে সন্ধেটা বুবুনের খাতায় আরও ধূসর।
উত্তরভারতের দিওয়ালির আলোয় কালীঠাকুর বা কালীমূর্তি চোখে পড়ে না। বরং অনেকের বাড়ি আলো করেন লক্ষ্মী। এছাড়া গোবর্ধন পুজো, ধনতেরাস ইত্যাদিও আছে। বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়, আত্মীয়-স্বজনরা আনন্দ ভাগ করে নিতে আসে। বুবুনদের কম্পাউন্ডের ভেতরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গার লোকেরা থাকত। তাদের অনেকের থেকেই অনেক আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে শুনত। অবশ্য ও এসব খুব একটা বুঝতও না, উৎসাহও ছিল না। কেউ কেউ বাড়িতে এসে প্রসাদ দিয়ে যেত। সময়ের ধুলো পড়ে এই ফ্লাশব্যাকগুলো তাই এখন খুবই অস্পষ্ট।
এভাবেই কখনও দিওয়ালির দিয়া, কখনও কালীপুজোর আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে খাতার পাতায়। এঁকে দিয়েছে কিছু আনন্দ, কিছু বিস্ময়, কিছু বিষাদ। বাইরে থেকে আলাদা মনে হলেও গভীরে গিয়ে এক হয়ে গেছে দু-জায়গার দু’টো উৎসবের আলো। কালীপুজোর পরেই আসে ভাইফোঁটা। বুবুনের কোনওদিনই ভাইফোঁটা ছিল না। তাই ছোটবেলায় একটু মনখারাপ হত মাঝেমাঝে। মামা কলকাতায় এলে মা আর মাসিরা ভাইফোঁটা দেয়। ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা’ এই মন্ত্রটা শুনতে বেশ লাগে। কখনও আবার মনে হত, ভাইফোঁটা যদি হয় তাহলে বোনফোঁটা বলে কিছু হয় না কেন?
আরও পড়ুন: ভূতেরা ফিরে আসে যে দিনগুলোয়

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় কালীপুজোর সঙ্গে দিওয়ালিও চলে আসছে। চোখ ধাঁধানো বিলবোর্ডে দেখা যায়, ‘দেওয়ালি অফার ২০% ডিসকাউন্ট’। সাবালক বুবুনকে ওর জানাশোনা সমবয়সি অনেক ছেলেমেয়ে সামাজিক মাধ্যমে, মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি দেওয়ালি’ জানায়। আশপাশে কারও বাড়িতে ‘দিওয়ালি পার্টি’ও হয়। বুবুনের ডায়েরিতে, মোবাইলের ড্রাফটে ধরা দেয় বদলে যাওয়া সময়ের কালীপুজো, দিওয়ালি বা দেওয়ালির আলো। রোদ পালটায়, পাতা ঝরে, উত্তুরে হাওয়া উঁকি মারে আগের মতোই। এক দু’বছরের মধ্যে কোনওবার কালীপুজোর কাছাকাছি সময় বেড়াতেও গিয়েছে ও। তখন শহর থেকে দূরে অন্য কোনও কবিতার ছবি এসে ধরা দেয়ে খাতার পাতায়। দূরে জ্বলে থাকা আলোরা একাকার হয়ে যায় তারাদের সঙ্গে। এও যেন এক আলোর খেলা। কখনও ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখেছে অন্ধকারের মাঝখানে নির্জন কোনও বাড়ির দাওয়ায় জ্বলছে একটা প্রদীপ। তার মধ্যেও একটা গা ছমছমে ভাব, রহস্যের গন্ধ আছে, লুকিয়ে আছে কোনও গল্প, অজানা কোনও জীবনের গল্প। বিসর্জনের দিন হলে ঘরে ফেরার সুর শুনে মনটা হু-হু করে ওঠে। ব্যর্থতার ভয়, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়, হেরে যাওয়ার ভয় ছায়া ফেলে ওর খাতায়। দেখতে পায় ঘুলঘুলি থেকে পালিয়ে যাওয়া পায়রাদের। কখনও অভিমান হয় নিজের ওপর, নিজের মানসিক সমস্যার ওপর। হয়তো হোঁচট খাবে, পথ হারিয়ে ফেলবে মাঝরাস্তায়। সবাই এগিয়ে যাবে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে সমস্ত সুর। ট্রেন ছুটে চলে নিজের মত। ইঁদুরদৌড় বাস্তবের দিকে, উচ্চাশার দিকে।
আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনওকিছুই আর আগের মতো নেই। অদৃশ্য ভয়, অজানা আততায়ী বদলে দিয়েছে জীবনের মানে, শুষে নিয়েছে সমস্ত ভালো থাকাকে, খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়েছে কত জীবন। কেউ ভালো নেই। ঘরবন্দি, একলা খাতায় এখন দাগ কাটে দমবন্ধ করা ভয়, হতাশা, অনিশ্চয়তা। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে আছে মাসের পর মাস। এ কোন সময়? ধরার জন্য হাত নেই, চোখ রাখার জন্য চোখ নেই, নেই হাঁটার জন্য পথ। হয়তো উৎসব আসছে অন্যভাবে। হয়তো মনে নয়, যেটুকু আসার আসছে শুধুই বাইরে, ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে। কিংবা উৎসব এসেছে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে, ভালো চিন্তা করে, সবার ভালোর কথা ভেবে। দুর্গাপুজোও তো এসেছে সেই একইভাবে। আসলে এই সর্বভূক সময়ে কোন উৎসব, কীসের উৎসব আর কেনই বা উৎসব? কালীপুজোও এসেছে ম্লান আলোয়। আর বাজি তো এবছর নিষিদ্ধ, যেটা বুবুনের মতো অনেকেরই মনে হয় একদিকে ভালোই হয়েছে। এবার না হয় মনের ভেতর জ্বলুক আকাশপ্রদীপ।
অলংকরণ: সৈকত দত্ত