মাতৃভাষা দিবসে ‘ভাইরাল’ উত্তম-কিশোর স্মৃতিমাখা গানের দৃশ্য প্রসঙ্গে

শুভ্রাংশু রায়
শিরোনামেই মাতৃভাষা শব্দের পরে লিখতে হচ্ছে এমন একটি শব্দ, যা হয়তো কোনো বাংলা অভিধানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘ভাইরাল’― শহর থেকে গ্রামগঞ্জে ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে যে শব্দ। অন্তর্জাল (ইন্টারনেটের বাংলা) দুনিয়ার সৌজন্যে নাকি সবকিছু ভৌগলিক এবং রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ভেদ করে চোখের পলকে সে নাকি এ-পাড় ও-পাড়ে পৌঁছে দিতে পারে অনেককিছুই। এই নিমিষে পারাপার যে শব্দের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাই হল ‘ভাইরাল’।
আরও পড়ুন: শতক পেরিয়ে ভাষার ‘হ য ব র ল’ ও একটি নাটক

জানি না করোনা পরবর্তী সময়ে কোনো বিদেশি শব্দ হিসেবে বাংলা অভিধানে এটি স্থান পাবে কি না, তবে ভাইরাল শব্দটির অস্তিত্ব বাঙালির মগজে ক্রমশ দ্রুত সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
ভাইরাল বর্তমানে অতি মহার্ঘ বস্তু। চিত্র তারকা থেকে তারকা ক্রীড়াবিদ সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ পোস্ট করেন। সুপ্ত আশা মনে হয় রয়ে যায়, যদি পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায়। পোস্ট ভাইরাল হয়ে রানু মণ্ডলের মতো অনেকের কপাল খোলে। কারো কারো কপালে পোস্ট ভাইরাল হয়ে তিরস্কার গণবিক্ষোভ এবং খুব পোড়া কপাল হলে জেল জরিমানাও জোটে। হাতের কাছে এই রকম অনেককটি উদাহরণ আছে। সেগুলির উল্লেখ করে লেখার দৈর্ঘ্য বাড়ালাম না। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট ভাইরাল হয় নাকি ভাইরাল করানো হয়, সে-নিয়ে অবশ্য বিস্তর বিতর্ক আছে।
আরও পড়ুন: ভাষার মাস কেন নয় ফাল্গুন
কারণ পোস্ট ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধালাভের একটা যোগসূত্র রয়েছে। তাই এই সন্দেহ অমূলক বলে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে হয়তো দেওয়া যায় না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পোস্ট ভাইরাল হয় পোস্টটির নিজগুণেই। এক্ষেত্রে জনতা কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই জনার্দন।
আজ দুপুরে এক পরিচিতের মাধ্যমে একটি গ্রুপে পোস্ট হতে দেখলাম। ১৯৮১ সালে রিলিজ হওয়া উত্তম কুমারের শেষ জনপ্রিয় ছায়াছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র একটি গান। ‘শুধু তুমি নও অবলাকান্ত, অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না।’ পর্দায় গানটিতে লিপ দিচ্ছেন উত্তম কুমার। মাঝেমাঝে সংলাপ আওড়াছেন অবিবাহিত অবলাকান্ত ওরফে সন্তোষ দত্ত। নেপথ্য কণ্ঠে আরেক কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমার। ভিডিয়ো ক্লিপিংসের স্ক্রিনের ওপরে লেখা ‘শুভ মাতৃভাষা দিবস’।

‘শুভ’ শব্দটি অবশ্য সাম্প্রতিককালের সংযোজন। সর্ব ক্ষেত্রেই শুভ জুড়ে দেওয়াটাই এখন রেওয়াজ। আগে বাঙালির শুধু বিবাহের আগে ‘শুভ’ যুক্ত হত, এখন সর্বত্র বিরাজমান। মনে পড়ে বছর পাঁচেক আগে এক শিক্ষয়ত্রী ‘শুভ মহরমের শুভেচ্ছা’ পেয়ে আঁতকে উঠে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘এ কী হচ্ছে’ মার্কা পোস্ট করে বসেছিলেন। তবে মাতৃভাষা দিবসের আগে ‘শুভ’ লাগালে অবশ্য মন্দ লাগে না। ১৯৮১ সালে রিলিজ হওয়া উত্তম কুমার অভিনীত ওগো বধূ সুন্দর সিনেমাটির এই জনপ্রিয় গানের উত্তম কুমার এবং সন্তোষ দত্তের প্রাণবন্ত অভিনয় এবং লিপ দেওয়া দেখে মনে হচ্ছিল অনেক কথাই। আর হ্যাঁ বাপি লাহিড়ীর সুর কিশোর কুমারের অনবদ্য গায়িকীর সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়েছে গানের কথা। তাই এই গানটি গুনগুন করার পাশে গানের লিরিসিস্ট বিভূতি মুখার্জির প্রত্যেকটি শব্দ আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। ভুল উচ্চারণ এবং জগা খিচুড়ি মার্কা বাংলাভাষার ব্যবহারকে গানের গীতিকার বিভূতিবাবু তীব্র শ্লেষ করেছেন। মধ্যবিত্তের ভুল এবং পাঁচমিশালি ভাষার ব্যবহারের হাজারো অজুহাত অবলাকান্ত ওরফে সন্তোষ দত্তের মাধ্যমে গানের মাঝেই উঠে এসেছে। তার প্রত্যুত্তরে ভাষাবিদ অধ্যাপক গগন সেন ওরফে উত্তম কুমার কখনো বলেছেন, ‘তাই বলে বলবে ভুল’ কখনো বা ‘শুধরে নাও’। বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে গীতিকার স্পষ্টতই গানটিতে লিখেছেন ‘এমন খিচুড়ি ভাষা কোনোদেশে কোনোকালে পাবে না তো আর।’ গানের একদম শেষের অংশের লাইনটি আরও সোজাভাবে তর্জনীটি মনে হয় প্রত্যেক বাঙালির দিকে তাক করে বলা ‘এমন গর্ব ভরে পরের নকল করে / আমরা ছাড়া আর দেখা যাবে না।’

আজ ভাষা দিবসের শেষ ঘণ্টায় এসে মনে হল গানের পর্দায় অনবদ্য অভিনয় প্রাণবন্ত সুর এবং গায়িকীকে ছাপিয়ে যেন কথাগুলো মনের অন্তঃস্থলে গিয়ে বিঁধচ্ছে। তাই শুভ মাতৃভাষা ক্যাপশনে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র এই গানটির ভিডিয়ো ক্লিপিংসের ভাইরাল হওয়াটা মনে হয় কোথাও যেন মনে হয় বাঙালির (অন্তত কিছুজনের তো বটেই) আত্মশ্লেষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ বলেই মনে হয়। তবে ভেবে নেবেন না আমি কেবলমাত্র মাতৃভাষায় সবকিছু চাই এই রকম দাবি সনদ জানাতে বসেছি। আপনি হিন্দি, ফরাসি, স্প্যানিশ, তামিল, সংস্কৃত চর্চা করুন না। কোনো সমস্যা নেই। এই তো এই লেখা লিখতে লিখতেই এক বন্ধুর অনুরোধে ইউটিউবে জনৈকা বৈশালী চক্রবর্তীর গাওয়া ‘না জানে কেউ ইয়েহ হোতা হ্যায় জিন্দেগি কে সাথ’ শুনছিলাম। বেশ ভালোই লাগছিল। আমরা কি ভালো হিন্দি বা ইংরেজি গান বা সিনেমা দেখবো না বা গল্প উপন্যাস পড়ব না অন্য ভাষায়? অবশ্যই দেখব, পড়ব, জানব― অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করব, তর্ক করব। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করে নয়। নিজের মাতৃভাষাকে অপমানিত বা লাঞ্ছিত হতে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার মনোভাবকে প্রশয় দিয়ে নয়। আপনি ভাষায় অবশ্যই বিশ্বজনীন হন। কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবহেলা করবেন না। এতদিন এগুলো ভাবেননি। ভাবুন। পর্দায় এই গানেই তো উত্তম কুমার ওরফে অধ্যাপক গগন সেন বলেছেন, ‘শুধরে নাও’।
লেখক সোনারপুর মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর
সত্যিই অসাধারণ ব্যাখ্যা। মাতৃ ভাষা নিয়ে এইধরনের সঙ্গীত কেন্দ্রিক ব্যাখ্যা যেনো শুদ্ধ মাতৃ ভাষা নিয়ে লেখা পড়ার ঝোঁক কে বহু গুনে বৃদ্ধি করে দেয়।