খড়দহে দোল খেলার কথা

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
ক.
খড়দহের দোল নিয়ে যদি কিছু লেখা হয়, অবশ্যই প্রথমে আসবে দোলমঞ্চ পাড়ায় আয়োজিত ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোল উৎসবের কথা। তার এক ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস আছে। খড়দহ ফেরিঘাটের কাছে প্রিয়নাথ বালিকা বিদ্যালয় এবং শ্রীগুরু গ্রন্থাশ্রমের মাঝে দোলমঞ্চ অবস্থিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের কাছে একটি স্থানে দোলের আগের দিন চাঁচড় অনুষ্ঠিত হয়। তখন মন্দির থেকে পালকিতে করে উপস্থিত হন শ্যামসুন্দর, শ্রীরাধিকা এবং অনন্তদেবের বিগ্রহ। চাঁচড় দেখিয়ে তাদের সেদিনের মতো মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।

পরদিন সকালে দেবতা আবারও আসেন দোল উপলক্ষে। ভক্তবৃন্দ রাঙিয়ে দেন বিগ্রহের পাদপদ্ম। সমবেত কণ্ঠ গেয়ে ওঠে দোলের গান। কী যে তার আকুতি, সেদিন উপস্থিত না থাকলে বোঝা যাবে না। সমস্ত দিন জুড়েই এই আনন্দমেলা চলে। রাতে ফিরিয়ে আনা হয় বিগ্রহত্রয়কে। সেখানেও একপ্রস্থ দোল খেলা চলে। দোলপর্বের শেষে রাতে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। খড়দহে গোপীনাথজির মন্দিরের উত্তর প্রান্তে রয়েছে বারান্দাময় এক দোলমঞ্চ। দোলযাত্রায় এখানেও আনন্দের হাট বসে।
আরও পড়ুন: ‘বসন্তে-বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক’

২. খড়দহবাসীর কৃষ্ণ আরাধনা
খ.
খড়দহে কয়েক দশক ধরে দোল উৎসব দেখছি। সাতের দশকে দোল উপলক্ষে যথেষ্ট অসভ্যতামি হত। সমবেতভাবে কাউকে কাউকে চ্যাংদোলা করে নর্দমায়, এঁদো পুকুরে ফেলে দেওয়া হত। আটের দশকে এইসব অনেকটা কমল। তখন আবির দিয়ে খেলা যথেষ্ট হত। বাচ্চারা পিচকারি ব্যবহার করত। আবির ফুরোলে বাঁদর রং, সোনালি/ রূপালি রং পকেটে নিয়ে ঘুরত কিশোর-তরুণরা। ওইসব রং মাখালে কারও মুখ আর চেনার জায়গায় থাকত না। রং তুলতে খুব সাধ্যসাধনা করতে হত। রহড়া খড়দহে পুকুর ঘাটগুলি দুপুর একটার পর থেকে রং তোলার স্নানার্থীতে ভরে যেত।
আমি নিজে কখনও সানুবাবুর পুকুর, কখনও মিশনের দিঘি, বিটি কলেজের পুকুর, কখনও রাক্ষসী পুকুরে (হরিসভার পিছনে এখন যেখানে পুণ্যানন্দ মুক্তমঞ্চ) স্নান করতে গিয়েছি দোল খেলে। ন’য়ের দশকে বাচ্চারা বেলুনে ভরা রং ব্যবহার করতে শুরু করে দিল খড়দহে। পিচকারির ব্যবহার হতে লাগল কেবল বেলুনে রং গোলা জল ভরতে। এখনকার বিষাক্ত রংগুলি গায়ে লাগলে জ্বলে যায়। কে শোনে কার কথা! ওই রং মাখতেই হবে।
আরও পড়ুন: বনের দোল, মনের দোল

গ.
আমার বাড়িতে কী ঘটত দোলের দিন জানাই। ক্লাস এইটের আগে বাবা জীবিত থাকাকালীন দোলের আগের দিন বাড়িতে এনে দিতেন মাটির ছোট রাধাকৃষ্ণ, তিনটি রঙের আবির, কিছু ফুল-মালা, সঙ্গে বাতাসা-ফুটকড়াই-মঠমিষ্টি। বাড়িতে তৈরি হত মালপোয়া, পায়েস। দোলের দিন সকালে পুজো হত। বাবা নিজে করতেন পুজো। পুজোর পর মাটির রাধাকৃষ্ণের পায়ে আবির দিয়ে তারপর বয়স অনুযায়ী বাবা-মা-দাদা-দিদিদের পায়ে আবির দিতাম। বোনের কপালে দিতাম আবিরের টিপ। বাবা-মা আশীর্বাদ করে কপালে আবির দিতেন। বাবা কখনও কেমিক্যাল রং কিনে দিতেন না। আবিরেই খেলতাম। সুগন্ধি ছিল সেই আবির। বাড়িতে ছোড়দি শ্বেতচন্দন আর রক্তচন্দন বেটে রাখতেন। চন্দনপাটায় বাসন্তী আর কমলা গাঁদাফুল বেটে নেওয়া হত।
আরও পড়ুন: রানাঘাটে রঙের উৎসব

এসব দিদিরা আমাদের মুখে ভালো করে মাখিয়ে দিতেন যাতে কেমিক্যাল রং বাইরের কেউ মাখালেও ত্বকের ক্ষতি না হয়। তারপর আমরা সকলে ছুটে চলে যেতাম বাইরে দোল খেলতে। সকাল ন’টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত দোল খেলতাম। অনেক বাড়িতে কাকিমা-জেঠিমার পায়ে আবির দিলে তাঁরা মুখে মিষ্টি আর জল ঢেলে দিতেন আলত করে। এসব খড়দহে প্রায় উঠে গেল ন’য়ের দশক থেকে। এখন খড়দহে ফ্ল্যাট কালচারে সবাই সবার সঙ্গে মেশেন না। এই দূরত্ব ভাঙা দরকার। মনে আছে আমাদের ছোটবেলায় বন্ধুদের মধ্যে আড়ি-ভাব ছিল। দোলের দিন সেসব দূর হয়ে যেত, সবার সঙ্গে তখন সদ্ভাব। দোল আমাদের কথা না বলার অভিমান দূর করত।
খড়দহের অ্যালবাম থেকে আরও কিছু ছবি:


ছবি ও ভিডিয়ো সায়ন ব্যানার্জী
লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার ফ্যাকাল্টির বিশিষ্ট অধ্যাপক।
খুব ভালো লাগলো
খুব ভালো লাগলো.
আমার বহু স্মৃতির কথা আপনি অতি সুন্দর ভাবে
তুলে ধরেছেন.
শুভ দোল যাত্রার শুভেচ্ছা রইলো.