জানকীবল্লভ মন্দির, তিলন্তপাড়া (সবং)

চিন্ময় দাশ
টেরাকোটা ফলক, স্টাকোর মূর্তি আর পঙ্খের অলংকরণ― তিনটি রীতিই প্রয়োগ করা হয়েছে এই মন্দিরে। এছাড়াও কেবল সামনের দেওয়ালই নয়, মন্দিরের চারটি দেওয়ালই সাজিয়ে তোলা হয়েছে তিনটি মাধ্যমে― যেমনটা বড় একটা দেখা যায় না। এমনই এক মন্দির আছে মেদিনীপুর জেলার সবং থানায়। যে মন্দিরের প্রতিষ্ঠার কাহিনিটি ভারী মনোগ্রাহী।
আরও পড়ুন: গোবিন্দরায় মন্দির, বালিসাহী- ভূঁঞাগড় (রামনগর- ২)

পূর্বকালে রীতি ছিল, সাধু-সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে তীর্থ পরিক্রমায় বের হতেন। মাঝেমধ্যে কোনও রাজা বা জমিদার বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন, যাত্রা বিরতি ঘটিয়ে। তেমনই একবারের ঘটনা। অযোধ্যা নগরী থেকে একদল সাধু পুরী দর্শন সেরে, এসে হাজির হয়েছিলেন পিংলার তিলন্তপাড়ার জমিদার বাড়িতে। সেখানে থাকতেই দলের প্রধান সাধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেসময় জমিদার বাড়ির এক বয়স্কা বিধবা মহিলা তাঁর সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। খুশি হয়ে সাধুজি তাঁকে উপহার হিসাবে কিছু চেয়ে নিতে বলেন। মহিলা বলেছিলেন― দেবেন যদি, আপনার শালগ্রামটি আমাকে দিয়ে যান। সাধু পড়লেন ফাঁপরে। বিগ্রহটি যে তাঁর বুকের ধন। হাত ছাড়া করেন কী করে? মুখে কিছু না বলে, অন্য একটি শিলা তুলে দিলেন মহিলার হাতে। মহিলাও আনন্দিত হয়ে বিদায় নিলেন।
আরও পড়ুন: ‘বাংলার শিবাজি’ শোভা সিংহের রঘুনাথ মন্দির, রাধানগর (ঘাটাল থানা, মেদিনীপুর)

কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ হল না। বরং বলা যায়, এক ইতিহাসের সূচনা হল তা থেকে। সেদিন রাতেই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহিলাকে দেখা দিলেন স্বপ্নযোগে। মহিলা জেনে গেলেন, আসল নয়, সাধু মহারাজ তাঁকে নকল বিগ্রহ দিয়েছেন। পর দিন সকাল। হাতির পিঠে চেপে বসেছেন সাধুর দল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিলাটি― আমার সঙ্গে চাতুরী করলেন, মহারাজ? এ বিগ্রহ তো আসল নয়। থমকে গিয়েছিলেন সাধু। লজ্জিতও হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে এটাও বুঝেছিলেন, দেবতাই চাইছেন না এখন থেকে যেতে। নিজের ঝোলা থেকে বের করে, নিজের প্রিয় বিগ্রহটি সেবাকারিণীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। দেবতার নাম― জানকীবল্লভ।
আরও পড়ুন: পার্বতীনাথ শিব মন্দির, উত্তর গোবিন্দনগর (থানা- দাসপুর, মেদিনীপুর)

দু’শো বছরেরও বেশি আগের ঘটনা এটি। সেদিন আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল জমিদার বাড়িতে। শিলাটি প্রতিষ্ঠা করে, সেবাপূজার প্রচলন করা হয়েছিল। মাইতি বংশের জমিদারি সঠিক কোন সময়কালে কিংবা কার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আর জানা যায় না। যে আদি পুরুষের নাম পাওয়া যায়, তিনি ছিলেন গঙ্গারাম মাইতি। তাঁর ২ পুত্র― বৈষ্ণবচরণ এবং ভুজবল। পরবর্তীকালে পরম বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণবচরণ-এর পরিবারটি ‘দাস’ পদবি গ্রহণ করে, ময়না থানায় উঠে গিয়েছেন। সেখানে নতুন করে ঠাকুরবাড়ি এবং উৎসবাদীর প্রচলন করেছেন তাঁরা।
ভুজবল-এর বংশধরগণই তিলন্তপাড়ায় বসবাস করেন। জানকীবল্লভ-এর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পূর্বকাল থেকে, শিব এবং অন্যান্য দেবতাও ছিলেন পরিবারে। শরিকগণের একাংশ পূর্বের দেবদেবীর অধিকারী হয়েছেন। অপর অংশ জানকীবল্লভের সেবাইত হয়ে আছেন। বর্তমানে ত্রয়োদশ/ চতুর্দশ পুরুষে পৌঁছেছে বংশটি।
আরও পড়ুন: রামজি মন্দির, রামবাগ (থানা- মহিষাদল, মেদিনীপুর)

যে অনিন্দ্য-সুন্দর মন্দির গড়া হয়েছিল দেবতার জন্য, সংক্ষিপ্ত একটি প্রতিষ্ঠা-ফলক আছে তার দেওয়ালে। টেরাকোটার ফলক। বানান এবং যতি-চিহ্ন হুবহু রেখে, বয়ানটি এরকম― “শ্রীশ্রী জান/ কি বল্লব/ ষুভ মস্তু/সকাব্দা /১৭৩২ /সন ১২/ ১৮ সাল”। অর্থাৎ ১৭৩২ শকাব্দ, বাংলা ১২১৮ সন, ইং ১৮১০ বা ১৮১১ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
লিপিতে সাল-তারিখ পাওয়া গেলেও প্রতিষ্ঠাতার নামের উল্লেখ নেই। তাঁর নাম পাওয়া যায় একটি লোকশ্রুতি থেকে। পূর্বে ভুজবলের কথা বলা হয়েছে। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বৃন্দাবন ছিলেন যেমন বিচক্ষণ, তেমনই প্রভাবশালী। একদিন গভীর রাতের ঘটনা। এক সালিশি সভায় বিচারকের কাজ সেরে ফেরার পথে, এক যক্ষ তাঁর পথ আগলে, সোনার মোহরে ভরা ৩টি কলস দিয়ে, শুভ কাজে ব্যয় করতে বলেছিল। (আমাদের অনুমান, হয়তো বা যক্ষ নয়, তিনি কোনও কৃপণ ব্যক্তি। তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় তুলে দিয়েছিলেন জমিদারবাবুর হাতে)।
আরও পড়ুন: শ্যামসুন্দর মন্দির, বালিপোতা (মেদিনীপুর কোতওয়ালি থানা)

তিন কলস মোহর দিয়ে তিনটি কাজ করেছিলেন বৃন্দাবন― ১. দেবতার জন্য পঞ্চ-রত্ন রীতির সুদৃশ্য মন্দিরটি নির্মাণ। ২. অতিথিশালাটিকে বড় আকারে পুনর্নির্মাণ। এবং ৩. বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে রাস-উৎসবের প্রচলন। বৃন্দাবন-এর নামেই উৎসবটির নাম হয়েছে― ‘বৃন্দাবন মাইতির রাস’। এই নাম আজও প্রচলিত। আজও জাঁক-জমকের সঙ্গে রাসের আয়োজন হয়। জায়গির সম্পত্তি দিয়ে ‘মিশ্র’ পদবির একটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে পুরোহিত নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁরাই আজও মন্দিরে সেবাপূজায় নিযুক্ত আছেন।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের গড় হরিপুরে শতায়ু পূর্ণ করা রামচন্দ্র মন্দির

ইটের তৈরি দক্ষিণমুখী মন্দির। উঁচু পাদপীঠ। তার উপর প্রশস্ত একটি প্রদক্ষিণ-পথ মন্দিরকে বেষ্টন করে আছে। সামনে একটি অলিন্দ, তাতে প্রবেশের জন্য খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। থামগুলি ইমারতি রীতির। দক্ষিণেরটি ছাড়া, পূর্ব দিকেও একটি দ্বারপথ আছে গর্ভগৃহের। মাথায় পাঁচটি রত্নেই কলিঙ্গশৈলীর রথ-বিভাজন করা। জানকীবল্লভের এই মন্দিরের খ্যাতি এর অলংকরণের জন্য। এমন মন্দির সারাজেলায় আর দু’টি নেই।
আরও পড়ুন: একদা রাজার হাতে গড়ে ওঠা মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার রঘুনাথ মন্দিরের চেহারা আজ বড়ই করুণ

অলংকরণগুলির কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে এখানে। ১. রামায়ণ কাহিনি থেকে― সীতাহরণ, জটায়ুর যুদ্ধ, সুর্পণখার নাসিকা-কর্তন, রাম-রাবণের যুদ্ধ ইত্যাদি। ২. কৃষ্ণ-কথা থেকে― জননী দেবকীর প্রসবকাল, কংসের মহামায়া হত্যার উদ্যোগ, শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে বসুদেবের যমুনা অতিক্রম, বালক কৃষ্ণের পর্বতাসুর (কৃষ্ণকে হত্যার জন্য কংসের নিযুক্ত দৈত্য) বধ, ঘোটকাসুর বধ ইত্যাদি। ৩. দেবী চণ্ডীর উপাখ্যান থেকে― মহিষাসুর বধ, রক্তবীজ বধ, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ ইত্যাদি। ৪. সামাজিক বিষয় থেকে― পর্তুগিজ জলদস্যুর অত্যাচার, চেয়ারে উপবিষ্ট সাহেব-মেমের সম্ভোগ, সাহেবের হরিণ শিকার ইত্যাদি। ৫. বিবিধ বিষয়ক― বহুতর গড়নের জলযান, নৌবহর সাজিয়ে সমুদ্রযাত্রা ইত্যাদি। হাতি, ঘোড়া, উটের সওয়ার। সিংহবাহিনী দশভুজা দুর্গা। চতুর্ভুজা কালিকামূর্তি। পশ্চিমের দেওয়ালে একটি বড় প্যানেলে― জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রা মূর্তি। এছাড়া, অনেকগুলি ফলক আছে, সহজেই মিথুন পর্যায়ে ফেলা যায় যেগুলিকে। দ্বারপাল মূর্তি, প্রতিকৃতি দ্বারপথ― কী নেই এই মন্দিরে?

কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করা হল। এমনই অসংখ্য ফলকে মোড়া দেবালয়টি। দেবতা যেন আদরের দুলাল। জমিদারি উজাড় করে অলংকারে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর আবাসখানি।
আজ জমিদারি নেই। বারো মাসের তেরো পার্বণে জৌলুসও নেই আগের মত। ম্লান হয়েছে জমিদারি বৈভব। বিশাল অট্টালিকা ধসে গিয়েছে একটু একটু করে। কয়েকটি জীর্ণ কোরিন্থিয়াম স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে কাছারিবাড়ির নিদর্শন হয়ে। জীর্ণ দশা বিশাল অতিথিশালাটির। নৌকাঘাট, সাধু-সন্ত-অতিথি-অভাবীজনেদের জন্য সদাব্রত― কিছুই নাই আজ আর, কিছুই।
আরও পড়ুন: বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত আর ভারী জীর্ণ কেশপুর বাদাড় গ্রামের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির

আছে কেবল দেবালয়খানি। আপন গরিমায়, আপন মহিমায় আজও বিরাজমান। জমিদার মাইতি পরিবার বিন্দুমাত্র সৌন্দর্যহানি ঘটতে দেননি দেবালয়টির। সারা মেদিনীপুর জেলায় এই এক মন্দির, যা দর্শন করলে, তার স্মৃতি বহুকাল জাগরুক থাকবে।
সাক্ষাৎকার
সর্বশ্রী বিকাশ কুমার মাইতি―
তিলন্তপাড়া।
সহযোগিতা
শোভন মাইতি―
তিলন্তপাড়া। অধ্যাপক তাপস কুমার মাইতি,
আইআইটি, খড়গপুর।
যাওয়া-আসা
মেদিনীপুর শহর, কিংবা বালিচক রেল
স্টেশন থেকে ময়নাগামী পথে জলচক। সেখান থেকে তিন কিমি পশ্চিমে তিলন্তপাড়া গ্রাম।
পুরো রাস্তাই মোটর চলাচলের উপযোগী।
খুবই ভালো লেখা।