ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আজকাল অনুষ্ঠানবাড়িতে, রেস্টুরেন্টে ভেজিটেবল চপ, ফিসফ্রাই, ভাজাভুজির সঙ্গে কাসুন্দি পরিবেশন হতে দেখা যায়। মাঝে অনেক বছর এই খাদ্যের কৌলিন্য তেমন দেখিনি। ইদানীং ফিরে আসছে কাসুন্দিপনা, তার মশলা রঙের বাহার আর ঐতিহ্য। আজ বলব সেই কাসুন্দি তৈরি দেখার আপন স্মৃতিকথা।
আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। সেবার গ্রীষ্মে বহরমপুর থেকে ঠাকুমা এসেছিলেন আমাদের খড়দহের বাসাবাড়িতে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কাসুন্দি তৈরি হওয়ার রেওয়াজ আছে। তাই একে কাসুন্দি-তৃতীয়া বলে। সেদিন নেতৃত্বে ছিলেন ঠাকুমা। রাজশাহী জেলার ঐতিহ্য তার মধ্যে। বাড়িওয়ালি এবং বাসাবাড়ির অন্য সব মহিলাদের মধ্যে সাজো-সাজো রব দেখা গেল। আমার মা শামিল হয়েছেন। আগের দিন থেকে উঠোন, ঘর গৃহস্থালি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছেন। উঠোন গোবরজল দিয়ে ঝাঁটিয়ে রাখা হয়েছে। আগের দিন কেনা হয়েছে বেশ কয়েক কেজি বড় কালো দানার সুপুষ্ট সরষে।
আরও পড়ুন: ‘বনলতা সেন’ আসলে মৃত্যু, জন্ম থেকে জন্মান্তরে যাবার বিশ্রাম
ওইদিন সকালে পরিষ্কার কাপড়ে সরষে ঢেলে তাতে ধান দূর্বা, গোটা হলুদ দিয়ে স্ত্রী আচার পালন করে নিলেন ঠাকুমা। তাঁর ছিল কাসুন্দি করবার ‘আইস্য’। লোকসংস্কৃতিগত এক বিশেষ অধিকার। সবাই কাসুন্দি করতে পারেন না। যেমন আমার মায়ের বড়ি দেবার আইস্য নেই। যাঁর আছে তিনি শুরু করে দিলে এবং মা-কে অনুমতি দিলে মা পারেন বড়ি দেবার বাকি কাজটি সম্পাদনা করতে। সেরকম আমসত্ত্ব, আচার, চাটনি করার কাজেও ‘আইস্য’ থাকতে হয়। গ্রামে এক একজনের থাকত, পল্লিঘরে তাঁদের ডাক পড়ত সেদিন। এসব মেয়েলি লোকাচারের ব্যাপার, এরমধ্যে ধর্মের ব্যাপার ছিল না।
সকল এয়োস্ত্রীরা সেদিন সকালে দলবেঁধে গেলেন সানুবাবুর পুকুরে সমবেতভাবে স্নান করতে, তারপর কোমর জলে দাঁড়িয়ে কাপড়ের মধ্যে কচলে ধুয়ে নিলেন সরষে দানা। পিতলের কলসি করে অ-ঘোলা জল ভরে নিয়ে আনলেন সকলে। বাড়িওয়ালার ছাদে কাপড়ে বিছিয়ে সরষে শুকিয়ে নেওয়া হল। সরষে শুকোলে হামান দিস্তায় তা গুঁড়িয়ে নেওয়া হল। এবার উঠোনে পড়েছে মাটির উনুন। আম-কাঁঠালের শুকনো ডাল জোগাড় করে রেখেছেন বাড়িওয়ালি কাকিমা নিজে। কাঠের উনুনে পুকুরের জল ফুটছে তো ফুটেছেই। আমরা পুরো বাড়ির সব বাচ্চারা হইহই করে বেড়াচ্ছি।
আরও পড়ুন: রঙের গাঁ খোয়াবগাঁ

ঠাকুমা আমাদের কিছুটা আম-জড়ানো করে দিয়েছেন, তাতে সেই বাটা সরষে। ও নিয়েই আমাদের মনোযোগ। দুপুরে সব ঘরের একত্রে ভোজন। হাঁড়ির জল আর্ধেক ফুটে এলে সরষে গুঁড়ো পরিমাণমতো ফুটন্ত জলে আলতো করে ঢেলে দিচ্ছেন ঠাকুমা। পরিমাণমতো লবণ। তার আগেই দিয়েছেন খোসা ছাড়ানো খানিকটা কাঁচা আমবাটা। এইবার মাটির ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ির মুখ ঢেকে ঘরে তুলছেন ঠাকুমা। মা-কাকিমারা সবাই শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনি দিচ্ছেন পিছনে পিছনে। এইভাবে কয়েক হাঁড়ি কাসুন্দি নামল। সব আয়োজন শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন: খড়দহে দোল খেলার কথা

ঠাকুমার নাম সাবিত্রী। কাসুন্দি গড়ে তিনি অস্তগামী সূর্যের লাল আভায় তাকিয়ে অনেক মন্ত্রোচ্চারণ করলেন— তার কিছুটা শাস্ত্রীয়, কিছুটা লৌকিক। ছোট হলেও বুঝতে পারছিলাম; কারণ কিছুটা সংস্কৃত এবং কিছুটা বাংলাভাষায় বলছেন। বাংলায় যা ছড়া বলছেন, তার মোদ্দা কথা ছিল— হে সূর্যের শক্তি, তোমার সৌকর্যে প্রস্তুত এই কাসুন্দি চমৎকার হোক, দুষ্ট অণুজীবের বাসা-বর্জিত হোক কাসুন্দি, তার গুণগত মান বজায় থাকুক, ঝাঁঝ পরিপূর্ণভাবে বজায় থাকুক, আগামী এক বছর তা গৃহের পরিবেশে সংরক্ষিত থাকুক, রং-ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকুক। ঠাকুমা-মা-কাকিমা প্রত্যেকেই সেদিন লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে এমন অনাড়ম্বরভাবে সেজেছিলেন, আজও তা চোখে ধরা আছে। আমার মা-কে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। কাকিমারা সেদিন ঠাকুমাকে বলেছিলেন ‘ষষ্ঠীদেবী’।
আরও পড়ুন: বনের দোল, মনের দোল

এরপর আরও কয়েকদিন হাঁড়িগুলি সারাদিন ছাদে রোদ খাওয়ানো হয়েছিল পরিচ্ছন্ন পোশাকে। তারপর প্রতিটি ঘরে এক একটি হাঁড়ি তুলে দেওয়া হল। মা-ঠাকুমা মিলে শিশি-বোতলে তুলে তুলে রাখলেন যতটা সম্ভব। আমাদের বহু আত্মীয় স্বজনকে ঠাকুমা ডেকে পাঠিয়ে নিজে হাতে উপহার দিলেন এক একটি কাসুন্দির শিশি। তারা সবাই উচ্ছ্বসিত। সেই বছরই ঠাকুমা মারা যান বহরমপুরে। তারপর আমাদের বাড়িতে কাসুন্দি কেউ কখনও তৈরি করেননি। বাজার থেকে কেনা অথবা কারও কাছ থেকে উপহার পাওয়া কাসুন্দিই খেয়েছি। কেবল মনে আছে, ওই কাসুন্দিটা ছিল বেশ তিতকুটে এবং খুবই ঝাঁঝালো। বাড়িতে পাটের তন্তু দিয়ে তৈরি সিকের উপর কাসুন্দির হাঁড়িটি ঝুলিয়ে রাখা ছিল অনেকদিন। মা সন্ধ্যারতির সময় ওখানেও ধূপদীপ দেখাতেন।