কলকাতার পার্বণকেন্দ্রিক সংগীত

জুবিন ঘোষ
এবার পার্বণকেন্দ্রিক গানগুলোর দিকে যাওয়া যাক। সংগীতের উপস্রোতগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে মিশে ভিন্ন স্বাদের আর একটা নতুন ধারা তৈরি করে। কলকাতার পার্বণকেন্দ্রিক সংগীতগুলোও সেইরকম। সারা পশ্চিমবঙ্গেই অসংখ্য পার্বণকেন্দ্রিক গান আছে, কিন্তু কলকাতার নিজস্ব গানগুলোর মধ্যে কোথাও একটা শিক্ষিত ছোঁয়া লেগে থাকে।
আরও পড়ুন: পুরাতনী কলকাতার গণিকা সংগীত

১. ক) কাদামাটির গান/ কাদাখেউড়ের গান
আগে বাংলা নববর্ষ হত ১লা অগ্রহায়ণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরৎকালীন যজ্ঞ হিসেবে দুর্গাপুজোর সময়টাই পড়ত। ১লা অগ্রহায়ণে নবমীর বলি সম্পন্ন করে কাদামাটির গান ধরত। কুসংসার ছিল যে বছরের শুরুতে অশ্লীল ভাষা শ্রবণে দেহ অশুচি হয়। তাই দেহকে অশুচি করবার জন্যই গাড়ল, অনাবিধানিক, অপশব্দে দুষ্ট ভাষায় গানগুলি রচিত হত এবং বাড়ির নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়েদের বয়স উপেক্ষা করেই তাদের সামনে গাওয়া হত যাতে তা শ্রবণে সেই বছর যমেরও অরুচি হয় সেই অশুচি দেহকে নিতে। কেমন ছিল তার ভাষা! শ্রীভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা কমলালয়-এ উনিশ শতকের বাংলাভাষার এই ছবি তুলে ধরেছেন―
‘‘মাটিতে ফেলিলে বীর্য মাটিতে শুকায়,
পুকুরে ফেলিলে বীর্য পুঁটি মাছে খায়।
সেই মাছ খেয়ে যে নারী গর্ভবতী হয়,
তাহার পুত্রেরে লোকে বোকাচোদা কয়।”
এটা গান না-হলেও কাদামাটির গানের ভাষা ছিল অনেকটা এইরকমই। দাশরথি রায়ের পাঁচালি সুরে পৌরাণিক আশ্রয়ে তৈরি একটা গানের কথা শুনুন―
“কাশ্যপ বলেন, লেটা,
ঘটালে নারুদে বেটা, তখনি বুঝেছি সেটা
সমূলেতে কল্লে খোঁটা, ভাল কি করেছ সেটা
নেহাৎ তোর বুদ্ধি মোটা, পরের মন্দ হবে সেটা
সেই কর্ম বড়ে আটা, ঋষির মধ্যে বড় ঠেঁটা
কে কোথা দেখেছে কটা, পোঁদে লাউ উপরে সোঁটা
হাতে করে সদাই সেটা, বেড়ায় কে হাবা বেটা
মাগু ছেলে নাই ন্যাংটা ওটা
কিছুতেই নাই যায় আটা, বেটা সব দুয়ারে ফ্যানচাটা…”
দুঃখের কথা লেখকদের অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হওয়ায় এবং রাঢ় অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় রাঢ় বাংলা ধারা মুখ্য ধারা বলে চালানো হল। বাকি উপধারাগুলিকে দমিয়ে দিয়ে তাদের বাংলাভাষার মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত করে অশিষ্ট, গ্রাম্য, গয়ারু ইত্যাদি বলে কাচের কফিনে তুলে রাখার ফলেই সেই সব কাদামাটির গানগুলি ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেল। কেউ সংগ্রহ করে রাখল না।
১. খ) চড়ক-গাজনের গান
কলকাতায় কালীঘাট থেকে চড়কের সন্ন্যাসীরা নৃত্যগীত পরিবেশন করতে করতে চিৎপুর রোড ধরে যেত। তাদের গানের ভাষা বন্দনামূলক ছিল। চড়কের গান ও নাচ দেখবার জন্য রাস্তার ধারে সারবেঁধে লোক দাঁড়াত। কলকাত্তাইয়া ভাষার নিজস্বতা এখানেও স্পষ্ট। অন্যান্য অঞ্চলের চড়কের গানের সঙ্গে কলকাতার চড়কের গান ছিল আর একটু সুসভ্য। যদিও বীভৎসতা সমান। চড়ক-গাজনের উৎসবে সঙ বেড়াত। যদিও সঙের গান একটা আলাদা অধ্যায়, তবে সঙের বেশ বাড়াবাড়ি ছিল চড়কের উৎসবে।
আরও পড়ুন: গঙ্গার পলিতে পুষ্ট কলকাতার লৌকিক গান

১৮৮৭-তে রচিত একটা জেলেনী সঙের গান―
“সরল পুঁটি এনেছি প্রাণ, নতুন গাঙের মাছ নিবি কেউ,
বউ দিদিরা ভাল করে বাহু
আমার পুঁটি দেখলে পড়ে, সোনা রুপো ঝক মারে,
বলতে পুঁটি গুমোর করে, কোথা লাগে ইলিশ মাছ।।
জেলে আমার ধীরে ধীরে, খেপ্লা জালে মাছ ধরে,
নাগর পটাই পাড়ায় ঘুরে, বেচি পুঁটি মাছ।।
সুখতারা ফুটলে পড়ে, জেলে মোর রয়না ঘরে,
আঁচলে ধরে আসে, ঘরে নাগ বাছের বাছ।।”
১৯২০-তে রচিত কর্পোরেশনের ধাঙড়দের পাওনা নিয়ে বিক্ষুব্ধ সঙের গান―
“ছোটা বড়া সব বাবুকো দেতা হ্যাঁয় সালাম,
জলদি সাফা করি হামি ড্রেন-ঝাঁঝরার কাম।।
শুনো বাবুলোগ মাণী, মুলুক্মে ভেজা কোম্পানী;
আগরি কাম কর দেগা, নেহি হগা বদনাম।।
ঝাঁঝরিকা পাঁক নেহি রাখেগা, উস্কো বাহার ফেক্কে দেগা;
বাবুসে বক্শিস লেগা, নাহি ছড়েগা হাম।।”
আরও পড়ুন: ‘উঠে যাওয়া’ গানের কলকাতায় চলুন…

আগেই বলেছি, গাজনের গান মানে সঙের গান নয়। কিন্তু গাজনে সঙ বেরোনোর চল ছিল। সঙের গান একসময় লিখেছেন, কালিদাস রায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর), কৃষ্ণদাস পাল বা রূপচাঁদ পাল। সঙের মিছিলের মূল লক্ষ ছিল নাগরিক-জীবনে-ঘটে-যাওয়া দৈনন্দিনের বিভিন্ন ঘটনাকে সাধারণ নাগরিকদের সামনে নিয়ে এসে সেইসব ঘটনাকে ঘিরে রঙ্গ-তামাশা করেও তাদের মনোরঞ্জনের সুযোগ করে দেওয়া।
১. ঘ) হরিবাসরের কীর্তন
কীর্তন গান ছিল কলকাতার অন্যতম প্রাণ। পুরনো কলকাতায় একাদশী তিথিতে সারারাত জেগে হরিবাসর শোনার রেওয়াজ ছিল। এখনও কোথাও কোথাও এই রেওয়াজ আছে। আমাদের চুঁচুড়াতেও হয়। আমার এক বান্ধবী সুদীপ্তা ব্রহ্মের বাবা বসিরহাটে প্রায়ই হরিবাসর করেন। দেবেন ঠাকুর জীবনীতে বলেছেন জোড়াসাঁকোতে তার দিদিমার হরিবাসরের কীর্তনের কথা। কীর্তনে কতগুলি ছন্দের বা তালের ব্যবহার দেখা যায়।
আরও পড়ুন: একসময় কলকাতায় নানান ধরনের উপধারার গান নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছিল

কীর্তন ভেঙে বহুধরনের লোকধারায় সুর ব্যবহার করা হয়েছে। নিমাই সন্ন্যাস পালা, বৈষ্ণব গানে এর প্রভাব দেখা যায়। এই কীর্তন গানের প্রভাবে যেটা দেখা গেল আধুনিক বাংলা গানে অনেক কীর্তন ছন্দ প্রয়োগ। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বহু গানে কীর্তন সুরের প্রভাব কখনও সরাসরি প্রয়োগ দেখা যায়। ফলে কলকাতায় হরিবাসর বাংলা গানকে পরবর্তীকালে প্রভূত পুষ্ট করেছে। এমনকী অত্যন্ত আধুনিক কলকাতার বিভিন্ন বাংলা ব্যান্ডেও কীর্তনের সুর লাগানো হয়েছে।
আগামী পর্ব পরের মঙ্গলবার...