জমল না ‘লক্ষ্মী’

অরিন্দম পাত্র
আবার হরর কমেডি, আবার অক্ষয় কুমার! তাই আশাবাদী হবার যথেষ্ট কারণ তো ছিলই ‘লক্ষ্মী’ নিয়ে। ‘ভুলভুলাইয়া’কে কি ভোলা যায়? গোটা ছবিতে ভূতভাগানো সাইকিয়াট্রিস্টের ভূমিকায় আক্কি বাবার সুক্ষ্ম কমিক অভিনয় পাশাপাশি প্রিয়দর্শনের অসাধারণ মেকিং। তবে এবারে অক্ষয় কুমারকে ব্যাটিং করতে হয়েছে একাই, সেরকম কোনও সহযোগিতা ছাড়াই, বিদ্যা বালানের মতো কাউকে তিনি পাশে পাননি যে!
আরও পড়ুন: ‘পাঠান’ ছবিতে ফের পর্দায় ফিরছেন শাহরুখ-সালমান

বড্ড বেশি ‘ভুলভুলাইয়া’-কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে আমার লেখাটা। কারণ আসল ফিল্ম ‘কাঞ্চনা’ আমার দেখা নেই, যার উপর ভিত্তি করে নির্মিত এই রিমেক ফিল্ম ‘লক্ষ্মী’। এই ফিল্ম নিয়ে তাই লিখতে গেলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখাটা আমার কাছে সহজ। কতটা মন ভরাল ‘লক্ষ্মী’ সে-প্রসঙ্গে একটু বাদে আসছি।
বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী যুবক আসিফ, যে একটা ‘জনজাগরণ মঞ্চ’ চালায় এবং সাধারণ মানুষকে তন্ত্র, মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, ভূত, প্রেত আর অন্য পাঁচরকম বুজরুকি সম্পর্কে সচেতন করে বেড়ায়। ঘোরতর বাস্তববাদী ও ভূতে অবিশ্বাসী আসিফ প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলে বেড়ায় যে ভূতের দেখা পেলে সে চুড়ি পরেও রাস্তায় বেরোতে রাজি! এহেন আসিফ ও তার স্ত্রী রেশমি, রেশমির বাবা ও মায়ের ২৫তম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দমন আসে। এরপর শুরু হয় কিছু অদ্ভুত ঘটনাবলি, যার জেরে ঘুম উড়ে যায় গোটা পরিবারের! আসিফের উপর ভর করে লক্ষ্মী নাম্নী এক মৃত তৃতীয় লিঙ্গ তথা বৃহন্নলার প্রেতাত্মা, যার কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে, একমাত্র তার অতীত ইতিহাসের গভীরে চাপা পড়ে রয়েছে এর কারণ! সেই কারণের রহস্য সন্ধানে আসিফ তথা লক্ষ্মীর জার্নি নিয়েই তৈরি ফিল্ম ‘লক্ষ্মী’!
আরও পড়ুন: নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ‘গজনি’ ছবির আমিরের সঙ্গে তুলনা কঙ্গনার!

২০১১ সালে রাঘব লরেন্স রচিত, পরিচালিত ও অভিনীত ফিল্ম ‘কাঞ্চনা’ সাউথ বক্স অফিসের একটি উল্লেখযোগ্য হিট ফিল্ম ছিল। অক্ষয় কুমারের প্রডাকশন হাউস কেপ অফ গুড ফিল্মস এবং ফক্স স্টার স্টুডিয়োর সৌজন্যে রাঘব স্বয়ং এই ছবিতে ফের ক্যামেরার পিছনে। মাঝে শোনা গিয়েছিল, প্রোডিউসারের সঙ্গে কিছু সৃজনশীল পার্থক্যের কারণে রাঘব লরেন্স মাঝপথেই ফিল্মের দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নাকি। এইসব টানাপোড়েনের প্রভাব কতটা চিত্রনাট্যের উপর পড়েছে, তা জানি না। তবে আড়াই ঘণ্টার ফিল্মের প্রথম ১ ঘণ্টা যথেষ্ট বোরিং লাগে। ফিল্মের জঁর হরর কমেডি হলেও হররের ছোঁয়া কিছু কিছু জায়গায় থাকলেও বাকি জায়গায় অনুপস্থিত ছিল, আসিফের শ্বশুরবাড়িতে অন্ধকারে জাম্প স্কেয়ার শটসগুলি বাদ দিলে। কমেডি বা বিশেষ করে কমিক পাঞ্চ সংবলিত ডায়লগের অভাব অনুভূত হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় কমিক অভিনয় অতিরিক্ত লাউডনেসের কারণে ভাঁড়ামোতে পর্যবসিত হয়েছে। তবে ফিল্মের টার্নিং পয়েন্ট দুটি। প্রথমত আসিফের উপর লক্ষ্মীর আত্মার ভর করা ও অবশ্যই অরিজিনাল লক্ষ্মীর মর্মস্পর্শী কাহিনি বর্ণন! এই দু’টি পয়েন্ট থেকেই চিত্রনাট্য ফের গতিশীল হয়ে চালিত হতে শুরু করে। ছবির শেষের অংশ কিছুটা অতিনাটকীয় মনে হলেও সেটা চিত্রনাট্যের দাবি মেনেই রাখা হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

অভিনয়ে ওয়ান ম্যান আর্মি অবশ্যই অক্ষয় কুমার। সাপোর্টিং প্লেয়ার ছাড়াই সারাক্ষণ ক্রিজের চারিদিকে চালিয়ে খেলার চেষ্টা করে গেছেন অক্ষয়। তবে এই অক্ষয় ‘ভুলভুলাইয়া’র মজাদার অক্ষয় নন। কেন জানি না মুখে বয়সের ছাপের পাশাপাশি অক্ষয়কে বেশ খানিকটা নিস্তেজ লাগল। সামাজিক বার্তাবহনকারী সিরিয়াস ফিল্ম করতে করতে অথবা হাউসফুল ৪-এর মতো থার্ড গ্রেড কমেডি ফিল্ম করতে করতে তবে কি অক্ষয় কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেছেন ইন্টেলিজেন্ট কমেডি অভিনয়ে? এর উত্তর প্রথমার্ধে ‘হ্যাঁ’ হলেও দ্বিতীয়ার্ধে অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বমহিমায় অবতীর্ণ হতে পেরেছেন আমাদের প্রিয় ‘খিলাড়ি’ কুমার। পাশাপাশি অরিজিনাল লক্ষ্মীর ভূমিকায় শরদ কেলকরের দুর্দান্ত ক্যামিও’র অব্যবহিত পরেই অক্ষয়কে ফের আগের ফর্মে যেন দেখতে পাওয়া যায় স্ক্রিনে। অবশ্য এটা নেহাত সমাপতন ও হতে পারে। অভিনয়ে অক্ষয়ের পরেই সবচেয়ে বেশি ছাপ রেখেছেন যিনি, তিনি হলেন আসল ‘লক্ষ্মী’র নাম ভূমিকায় শরদ কেলকর। স্বল্প স্ক্রিন প্রেজেন্সে কয়েকটা মাত্র সিনেই জমিয়ে অভিনয় করেছেন শরদ। এ বছর ‘তানাজি’ ফিল্মে ছত্রপতি শিবাজি’র ভূমিকায় অভিনয় করার পরে এটাই সম্ভবত শরদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বড়পর্দায়। নায়িকার ভূমিকায় কিয়ারা আদবানিকে শোপিস ছাড়া আর কিছু মনে হল না। এছাড়া আর ছাপ রাখার মতো সাপোর্টিং অভিনয় সেভাবে পাওয়া গেল না। আসিফের শ্বশুরের ভূমিকায় রাজেশ শর্মার সেভাবে কিছু করার ছিল না। বাকিদের অভিনয় কিছুটা অতিঅভিনয়ে আক্রান্ত।

ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেশ ভালোই। ছবির গান একটাও মনে থাকে না শেষ হবার পরে, অল্প স্বল্প ‘বার্জ খলিফা’ বাদ দিলে, যেটা অত্যন্ত অনাবশ্যকভাবে চিত্রনাট্যে প্রযুক্ত হয়েছে। ‘বোম বোম ভোলে’ গানের সঙ্গে অক্ষয় ও অন্যান্য শিল্পীদের ডান্স কোরিওগ্রাফি প্রশংসার দাবি রাখে। ভিএফএক্স-এর কাজ মোটামুটি লেগেছে।
সবমিলিয়ে ‘লক্ষ্মী’ একটি বিনোদনমূলক ছবি যা একবার অন্তত দেখাই যায়, তবে বেশি প্রত্যাশা থাকলে হতাশ হবেন। পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি সমাজের সাধারণভাবে এড়িয়ে চলা বা ঘৃণামূলক আচরণের বিরোধিতা করে একটি দৃঢ় সামাজিক বার্তাও দেওয়া হয়েছে এই ফিল্মে।