অঙ্কিতা
প্রাপ্যাবন্তীনুদয়নকথাকোবিদগ্রামবৃদ্ধান্ —মেঘদূতম, পূর্বমেঘ (শ্লোক ৩০) কালিদাস
অবন্তীপুরে আসিলে শুনিবে গ্রামের বৃদ্ধ তথা,
কবিদের মতো উদয়ন-গীতি কহিছে বৃহৎকথা। —নরেন্দ্র দেব (অনুবাদ)
অবন্তীপুর। উজ্জয়িনী। মালব। একই স্থানের ভিন্ন ভিন্ন নাম। নামগুলো শুনলেই মনে ভেসে ওঠে এক প্রাচীন নগরী। প্রাচীন কিন্তু সমৃদ্ধ। সেই নগরীর সম্রাট গুপ্তসম্রাট বিক্রমাদিত্য। সেই সম্রাটের সভা উজ্জ্বল নয়টি জ্ঞানরত্নে। রাজ্যে অসংখ্য স্তূপ, বৌদ্ধবিহার। রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় শিপ্রা, নর্মদা। তাদের দানে শক্ত কালো মাটি উর্বর হয়। ফসল ফলে। বলা হয় মালব শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ মালভ থেকে, যার অর্থ ‘লক্ষ্মীর গৃহের অংশবিশেষ’। কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে বলেছিলেন, উজ্জয়িনী আর বিশালা স্বর্গের সঙ্গে সমতুল্য। অবশ্য লক্ষ্মীর আশীর্বাদ আজ আর দেখা যায় না মধ্যপ্রদেশের সাধারণ জনজীবনে। কিন্তু এত সুন্দর সুন্দর কবিতার মতো নামগুলো ত্যাগ করে স্থানটা কেন যে মধ্যপ্রদেশ হয়ে গেল, তা আমার বুদ্ধির বাইরে।
আরও পড়ুন: রঙের গাঁ খোয়াবগাঁ

তা বুদ্ধিটুদ্ধি বাইরে রেখেই, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে আমরা হাওড়া থেকে ইন্দোরগামী এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল— উফ্, শান্তি!
পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই অবাক হবেন এই ভেবে যে যাত্রা শুরু করেই শান্তির জল ছেটাই কেন? সে তো অন্তিমের আচার। আসলে যাঁরা কোনও ট্যুরিজমের সাহায্য ছাড়া নিজেরাই সমস্ত ব্যবস্থা করে ঘুরতে যান, তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন এক-একটা ট্যুর প্ল্যান করতে কীরকম খাটুনি যায়। এই ট্যুরের ইটিনারি বানাতে আমার প্রায় মাসখানেক সময় লেগেছিল। সেই এক মাসে আমি মধ্যপ্রদেশের ম্যাপ আর IRCTC-র টাইম টেবিলে ডুবে ছিলাম।
আরও পড়ুন: ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদ

যাত্রা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে, জুন মাসের প্যাচপেচে গরমে কলকাতায় বসে আমার মন যখন একটুকরো হিমালয়ের জন্য হা-হুতাশ করছিল, তখন মাতৃদেবী আমার মাথায় একবাটি বরফ বসিয়ে বলেছিল; আর পাহাড় নয়, এবার ল্যান্ড। মনের দুঃখ মনে চেপে ম্যাপে চোখ বোলাতে বোলাতে খেয়াল করলাম, আরে ভারতের কটিদেশে একটা গোটা রাজ্যই পড়ে আছে অস্পৃষ্ট হয়ে!
ছত্রিশগড়কে বাদ দিলেও দেখা যায় মধ্যপ্রদেশ রাজ্যটি আড়েবহরে যথেষ্ট বড়। লক্ষ্মীশ্রী তেমন না থাকলেও প্রায় আড়াই হাজার বছরের উজ্জ্বল ইতিহাসে সে সমৃদ্ধ। জায়গাটা সম্পর্কে সামগ্রিক একটা ধারণা পাওয়ার জন্য গুগল খুললাম। কয়েক দিন বাদে মধ্যপ্রদেশের অজস্র ছোটবড় দর্শনীয় স্থানের নাম এবং তাদের ভৌগলিক অবস্থান কণ্ঠস্থ করার পরে আমি বুঝলাম বেশ বড়সড় ভুল করেছি। বেড়াতে যাব আমরা চার জন— মা, বাবা, সন্তু (আমার worst half) এবং আমি। ছোটদল, কিন্তু বায়নাক্কা প্রচুর। ইতিমধ্যে মা এসে বলে গেছে, একবারে পুরো মধ্যপ্রদেশ প্ল্যান কর, দ্বিতীয় বার যেন যেতে না হয়। সন্তু ফোন করেছে, সে অফিস থেকে ছুটি পাবে ১৬ দিনের। বাবা জানিয়েছে, পার হেড পঁচিশ হাজারের বেশি যেন না হয়। বিভিন্ন ট্যুরিজমে ফোন করে করে পয়সাকড়ির ক্ষেত্রে আমি যা জানছি, তা আর কাউকে জানাচ্ছি না। তাহলে দেখা যাবে তক্ষুনি হয়তো ট্যুরটাই বাতিল হয়ে গেল।
আরও পড়ুন: আঁকা-লেখা

অবন্তী রাজ্যের নাম প্রথম পাওয়া যায় বৌদ্ধ গ্রন্থ সুত্তপিটকের অঙ্গুত্তরনিকায় অংশে। ওই গ্রন্থে অবন্তীকে ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম বলা হয়েছে। অবন্তীর নাম আছে রামায়ণ, মহাভারতেও। মহাভারতের পরবর্তী সময়ে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে অবন্তী হয়ে ওঠে পশ্চিম ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সেই সময় এই রাজ্যের শাসনকর্তা ছিল হৈহয় জাতি, নাগদের থেকে তারা এই ভূমি কেড়ে নিয়েছিল। তারপরে শাসক হিসাবে আসে নন্দ বংশ ও মৌর্য। কিন্তু অবন্তী বা মালব বা বর্তমানের মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাংশ মূলত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল গুপ্ত যুগে। লক্ষ্মী সরস্বতীর আশীর্বাদে অবন্তী রাজ্যের তখন সুবর্ণ যুগ। অবশেষে প্রায় একমাস ধস্তাধস্তি করে একটা মোটামুটি ট্যুর প্ল্যান রেডি হল। যাওয়া-আসা ছাড়া পুরো ট্যুর টাইম ছিল ১৬ দিনের। যাত্রা শুরু হবে ইন্দোর থেকে। ঠিক হয়েছিল ইন্দোর-বেঙ্গালুরু সন্তু প্লেনে যাতায়াত করবে। বাকিরা হাওড়া-ইন্দোর ট্রেনে। পকেটখালির জমিদারেরা যা হিসাবপত্র দিল, তাতে দেখা গেল ট্যুরের প্রথমার্ধ আমরা গাড়ি করে ঘুরলে, শেষার্ধ ভরসা হবে ভারতীয় রেল। সেইমতো তারিখ ধরে ধরে একের পর এক টিকিট কাটা হল চার মাস আগে।
আরও পড়ুন: স্মৃতিতে সুন্দরলাল

টিকিট পর্ব শেষ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম হোটেল খুঁজতে। যেহেতু আমাদের ভ্রমণগুলো ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের ছুটির সময়-ভিত্তিক, তাই অতি অবশ্যই হোটেল আগে থেকে বুক করতে হবে। এই হোটেল বুকিং না থাকার জন্য কয়েক বছর আগে কেরল গিয়ে আমরা ভারী বিপদে পড়েছিলাম। এবারে তো ১৬ দিনে প্রায় ১০/১২টা হোটেল বুকিংয়ের ঝামেলা। হোটেল পর্ব চুকতে চুকতে চলে গেল আরও এক-দেড়মাস। এর মাঝেই একদিন মনে করে অনলাইনে টিকিট কেটেছি কানহা ন্যাশনাল পার্কের। মাত্র একদিন লেট করার জন্য কোর এরিয়ায় কোনও বুকিং পাইনি। নিতে হয়েছে বাফার এরিয়া।
আরও পড়ুন: ‘এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি’, জন্মদিনে ঝোড়ো কবি নজরুল

শুরুর থেকে আমি বারংবার অবন্তী অথবা মালব-এর কথাই বলছি। এই স্থানটি আজকের মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের একটা অংশ জুড়ে আছে মাত্র। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশের উত্তরাংশ আর পূর্বাংশ যথেষ্ট দর্শনীয়। সেখানের ইতিহাসও কিছু কম নয়। প্রাচীন জনপদের হিসাব নিতে গেলে দেখা যায়— বিদর্ভ, অবন্তী, চেদী, দশার্ণ, পুলিন্দা এই জনপদগুলিই আজকের মধ্যপ্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। আমাদের ট্যুর ছিল বর্তমান মধ্যপ্রদেশ রাজ্য ধরে। অবশ্য সময়ের কারণে কিছু কিছু দর্শনীয় স্থান বাদ পড়ে গিয়েছিল।
পাক্কা ষোলো দিনের লম্বা ট্যুর। হিসেব রাখার জন্য আমি পুরো ট্যুরটা তিন ভাগে ভাগ করেছিলাম। ইন্দোর খণ্ড, ভোপাল খণ্ড ও খাজুরাহো খণ্ড।
ইন্দোর অংশে ছিল— ইন্দোর, উজ্জয়িনী, মান্ডু, ওমকারেশ্বর-মাহেশ্বর।
ভোপাল অংশে ছিল— ভোপাল, পাঁচমড়ি, কানহা, জব্বলপুর, সাঁচি-বিদিশা।
খাজুরাহো অংশে ছিল— খাজুরাহো, ঝাঁসি-ওরছা, গোয়ালিয়র।
আরও পড়ুন: আসবে ঝড়, নাচবে তুফান…

হোটেল মিটলে শুরু হল গাড়ি। এবারে মাথায় হাত। যাকেই জিজ্ঞেস করি পার ডে চার-সাড়ে চার হাজার টাকার নিচে কেউ নামে না। তাও ফোর সিটার। বাবা বলল, তাহলে খানিকটা বাসে ঘুরে নে। মা-ও জানাল, হ্যাঁ তোর দাদু তো বাসে বাসেই ঘুরেছিল পুরো মধ্যপ্রদেশ। আমি আর মাকে বললাম না, দাদু যেভাবে বুড়ো বয়সেও ঘুরে বেড়াত সেই ধকল এখনই মা-বাবার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল। আর আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম। ট্রেনে আমার তেমন অসুবিধা নেই, কিন্তু বাসে করে দূরপাল্লার জার্নি করার কথা উঠলেই আমার কান্না পেয়ে যায়।
একটি গাড়ির খোঁজে আমি পাগলের মতো এদিক ওদিক ফোন করে বেড়াতে লাগলাম। অবশেষে আমাদের উদ্ধার করল সন্তুর এক কলিগ। তিনি উজ্জয়িনীর লোক। ওখানকারই এক রেন্টাল কারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের জন্য খুব ভালো একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। সত্যি বলতে ওই গাড়ি আর তার ড্রাইভার আমাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। এত ট্যুর করেছি, কিন্তু এত ভালো ড্রাইভার খুব কম সময়ই পেয়েছি আমরা।
আরও পড়ুন: সম্বুদ্ধজাতিকা (২য় অংশ)

সব কিছু ঠিকঠাক। লাগেজ গোছানো কমপ্লিট। অজস্র টিকিট, হোটেল কনফার্মেশন, আইডি প্রুফ, অরিজিনাল এবং জেরক্স, আমার ছোট নোটবুকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের নাম, ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা মিউজিয়াম ইত্যাদির খোলাবন্ধের সময়সূচি। সবমিলিয়ে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাসের উত্তরপত্রের থেকেও মোটা একটা ফাইল হয়ে গেছে। মা, বাবা, আমি কলকাতায়। হাওড়া থেকে আমাদের টিকিট কাটা। আমাদের যাত্রার আগের দিন রাতে সন্তু বেঙ্গালুরু থেকে ফোন করে জানাল, হ্যাঁ গো, সাতনা থেকে তোমাদের ফেরার টিকিটের সিটগুলো তো এখনো কনফার্ম হয়নি। কী করবে?
পুরো মধ্যপ্রদেশের ল্যান্ডস্কেপটাই আমার মাথায় ভেঙে পড়ল।
‘এ ছোঁড়া বলে কী!’
চলবে…
খুব ভাল লাগছে অঙ্কিতা
ভালো লাগল। সুন্দর লেখা ও নির্মিতি।