নৃসিংহবন্দিতা দেবী বংশবাটী-বিলাসিনী

পূর্বা মুখোপাধ্যায়
হুগলি জেলার প্রাচীন জনপদ বংশবাটী, একপাশে ব্যান্ডেল, অন্যপাশে ত্রিবেণী, চুম্বকের মতো টানল আমায়। দু-হাজার উনিশের এক নভেম্বরের সকালে প্রথমবার গিয়ে মনে হল, না, কালীমন্দির নয়, যেন কোনও গথিক গির্জার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। পাশেই বাংলার নিজস্ব টেরাকোটা শৈলীতে গড়া অনন্ত বাসুদেব মন্দির। ভিড় বেশি নেই। একটু পরেই আরতি হবে। অন্নভোগের জন্য কুপন নিলাম। চারিদিকে ছিমছাম বাগান, গাছপালায় পাখিদের কাকলি শোনা যাচ্ছে। পাথরের প্রশস্ত চত্বরে উঠে খানিকটা হেঁটে গেলে গর্ভগৃহ। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর সহস্রদল পদ্ম, সেই সহস্রারের উপর হৃদয়াত্মক অষ্টদল পদ্ম, তার উপর ত্রিকোণাকার বেদিতে শায়িত মহাকাল, তাঁর নাভিদেশ হতে উদ্গত মৃণালসূত্রের উপর দ্বাদশদল পদ্মে নিমকাঠে নির্মিতা নীলবর্ণা যে দেবী এক পা মুড়ে বসে আছেন, বাম হাতে খড়্গ ও নৃমুণ্ড, দক্ষিণ হাতে শঙ্খ ও বরাভয়, ইনিই আরাধ্যা। বছরে মাত্র একবার, দীপান্বিতা তিথিতে কালীসাজে ইনি আবির্ভূতা হন। সেদিন স্বর্ণজিহ্ব তিনি, আলোল কুন্তলা, বসনবিহীনা, শুধু ফুলসাজে দেহলতা আচ্ছাদিত করেছেন।
আরও পড়ুন: বঙ্গদেশে চ কালিকা

কে ইনি? ইনি ‘উড্ডীশতন্ত্র’ গ্রন্থের রচয়িতা এক কবির মানসপ্রতিমা, দেবী হংসেশ্বরী। কে এই কবি? বংশবাটী, অর্থাৎ বাঁশবেড়িয়ার ভূস্বামী, অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামেশ্বর রায়ের উত্তরপুরুষ, রাজা নৃসিংহদেব রায়। ইতিহাস থমকে আছে এই গড়ে, গড় সংলগ্ন মন্দিরচত্বরে। মুঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বস্ত ভূস্বামী হিসাবে এই দত্তরায় বংশ ক্রমে রায় এবং মজুমদার উপাধি ও প্রচুর ভূমিলাভ করেন। বর্ধমানের পাটুলি থেকে রামেশ্বর সাড়ে তিনশো প্রজাসহ স্থায়ীভাবে বংশবাটীর অধিবাসী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পুত্র গোবিন্দদেবের অকালমৃত্যুতে জমিদারির বেশ কিছু অংশের অধিকার হারাতে হয়। তখন ব্রিটিশ আমল কায়েম হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিসের হস্তক্ষেপে কিছু জমি পুনরুদ্ধার হয়েছে, বাকি ভূসম্পত্তি ফেরত পেতে লন্ডনে যাওয়া আবশ্যক। এমতাবস্থায় গোবিন্দদেবের পুত্র নৃসিংহদেব কাশীযাত্রা করলেন। কেন? তাঁকে তন্ত্র টেনেছে।
আরও পড়ুন: অন্য মনে, অন্য খাতায় আলোর আখর

তখন ১৭৯২ সাল। সাতবছর পর, যিনি স্বগ্রামে ফিরলেন, তিনি কি রাজা? তিনি উড্ডীশতন্ত্রের লেখক নৃসিংহদেব, যিনি ঘোরবশে নিজমাতা, বিধবা হংসেশ্বরীকে দেবীরূপে আরাধ্যা করছেন, আর মনে জানছেন প্রকৃত হংসেশ্বরীর স্বরূপ, হং স্বঃ— এই তো প্রাণবীজ আর শক্তি, শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িত অজপায় দেহযন্ত্রে যে প্রবাহ নিত্য বেজে চলেছে! হংস স্বয়ং জগৎপ্রসবিনী শিবসম্মিলিতা ভগবতী, কুলকুণ্ডলিনীরূপে যিনি মূলাধারে শায়িতা, জাগরণের অপেক্ষায়… তাঁকে জাগাবেন না নৃসিংহদেব? সেই পরম ঘোরেই তো তিনি লন্ডনে বিষয়োদ্ধার-যাত্রার খাতে সঞ্চিত অর্থ মন্দির নির্মাণে ব্যয় করবেন, মনস্থ করলেন! সেই পরম ঘোরেই তো কল্পনায় ওই গথিক ছাঁদে টের পেলেন তন্ত্রমতে দেহযন্ত্রের কেন্দ্রগুলিকে— ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ আর চিত্রিণী, পঞ্চনাড়ী ও সুষুম্নাস্থ ষটচক্রের দ্যোতক মন্দিরচূড়ার ওই তেরোটি মিনার, যার সামনে দাঁড়িয়ে চমৎকৃত দর্শক হয়তো ভাবছেন বাঃ, লোকটা তাহলে ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষক ছিল! আবার গর্ভগৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছেন রাজার খামখেয়ালে রাজস্থানি নকশায় ভরে আছে ছাদ আর দেওয়াল!
আরও পড়ুন: সত্যি ভূতের গল্প ১

এমন বিচিত্র শোভার মন্দির বাংলায় আর দ্বিতীয়টি নেই। হ্যাঁ, কালের বুকে উজ্জ্বল একটি কাব্যরূপ ছাড়া, উদ্দাম কবিমনের কল্পনা ছাড়া হংসেশ্বরী মন্দিরে আমি আর কিছু দেখতে পাইনি। মন্দিরের সম্পূর্ণ নকশা রাজার নিজের আঁকা। তেরোটি মিনারে নির্মিত দ্বিতলে যেতে তেরোটি সিঁড়ি পেরোতে হয়, তারপর নাকি আছে একটি ভুলভুলাইয়া, সেটি পার হতে পারলে নির্বিকার মহাকালেশ্বর শ্বেতশিবের সঙ্গে আরাধকের দেখা হবে। এই অপূর্ব কল্পনাপ্রবাহে ভাসতে ভাসতে রাজা নৃসিংহদেব ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করলেন, কিন্তু স্বপ্ন অসমাপ্ত ফেলে ১৮০২-এ তাঁকে চিরবিদায় নিতে হল। সহমরণে গেলেন তাঁর প্রথমা স্ত্রী। দ্বিতীয়া যিনি, রানি শঙ্করী, স্বামীর স্বপ্নকে পূর্ণরূপ দিয়ে গেলেন ১৮১৪ তে। চূনারের পাথর, রাজস্থানের মিস্ত্রি, নিপুণ নকশা… ঠিক যেমনটি ছিল তাঁর প্রিয়তমের পরিকল্পনা। শঙ্করীও তো দেবীরই অন্য একটি নাম!
আরও পড়ুন: ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ’

রানি তাঁর প্রিয়তমের সৌধ সম্পূর্ণ করার পর, তৎকালীন খরচ দাঁড়িয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। বিধবা রমণীর অপরাভূত পতিপ্রেম। স্বয়ং ঈশ্বরীর মায়া। তাঁর লীলা।
ছবি সংগৃহীত