জয় ভদ্র
যে-মানুষটির উপর আজ আমাকে লিখতে বলার আমন্ত্রণ পেলাম— বলতে গেলে প্রথমে প্রায় নিমরাজিই ছিলাম। নিমরাজি ছিলাম এই কারণে যে বাঙালি তথা ভারতীয় জীবনে মনে করি এই মানুষটির উচ্চতা এভারেস্টের চেয়েও বেশি, ওজনে সেই পাহাড়কেও অতিক্রম করে গেছেন। সুতরাং তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা আমার কাছে নিছক ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী-বা হতে পারে। পাঠক, আপনারা বুঝতেই পারছেন, আমি ঠিক কোন মানুষটির কথা বলছি। হ্যাঁ, উনি আমাদের সকলের প্রিয়, অতি প্রিয়, আমাদের স্বপ্নের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
আরও পড়ুন: ১২৫: প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে সুভাষচন্দ্র

আমি কোনও নেতাজি গবেষক নই। তাঁকে নিয়ে এখনও প্রায়ই বিভিন্ন গবেষকদের নিত্যনতুন গবেষণাপত্র গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়ে চলেছে— বলা বাহুল্য এই গবেষণাগুলি সত্যিই আধুনিক, সমকালীন সময়ের আধুনিক চোখ দিয়ে তাঁকে দেখা, তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং তাঁর ওপর পাওয়া বিভিন্ন তথ্যের ওপর ক্ষুরধার মগজের আতশ কাচ দিয়ে তাঁকে যাচাই করা। এইসব বই সব সময় যেমন হাতেও আসে না, আবার ইচ্ছে থাকলেও সময়াভাবে ও নানান কারণে পড়েও হয়ে ওঠা হয় না। সুতরাং তাঁকে নিয়ে আমার বা আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের কোনও আলটপকা কিছু বলা বা মন্তব্য করার অধিকার আছে কি? তবুও মন চাইল না কিছু না-বলতে, কারণ ‘নেতাজি’ এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক অপরিসীম শ্রদ্ধা, আবেগ ও কৌতূহলের, আমার মতো সাধারণ আমজনতার ন্যায্য অধিকার বলেই মনে করি। কারণ এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটি যে-শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছেন, অথবা এখনও পেয়ে চলেছেন তা তো শুধুমাত্র আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই। নেতাজিকে ঘিরে সাধারণের যে আবেগ-অনুভূতি মেশানো প্রেম, যে-রহস্যময়তা তাঁকে ঘিরে জ্যোতির্বলয় সৃষ্টি করেছে তার প্রতি প্রবল কৌতূহল আমাকে বা সাধারণ মানুষকে চুম্বকের মতো টেনে ধরবে— এটাই স্বাভাবিক! ভারতের বা বা ইউরোপের তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতারা তাঁকে নিয়ে আপাতত শ্রদ্ধার রঙিন মোড়কে যার ভিতর তাঁকে মিথ্যে প্রমাণ করার বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অস্বীকার করার যে মুচমুচে প্যাকেজটি আমাদের কাছে পরিবেশন করে আসছে, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বা নেতাজি-প্রেমিকদের কি যায় আসে! ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের সাধারণ নাগরিকদের প্রাত্যহিক যে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলির (রাষ্ট্রনৈতিক তরে বলছি না— বলতে পারলে আরও ভালো লাগত; সেই সাহসটাই-বা কোথায়, মালগাড়ি বা ক’টা মাথা আছে?) সম্মুখীন হতে হয়, এবং তা হতে হতে অন্তর্দৃষ্টির যে হার্ড-ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না! নাগরিক হিসেবে যতই আমরা ‘…’-এর কাছে আধুনিক স্লেভ হই না কেন ‘বোধগম্যের’ এই Schema-টি প্রাকৃতিকভাবেই প্রখর হয়ে গেছে। তাই গবেষণামূলক বইপত্র পড়ার বিশেষ প্রয়োজন সেখানে হয় বলে তো মনে হয় না (যেমন, শ্রীরামকৃষ্ণকে কোনও গবেষণামূলক গ্রন্থ পড়তে হয়নি)। আমার এই cognitive development-এর জায়গা থেকেই এই ওয়েবজিনের সম্পাদকের অনুরোধ ফেরাতে পারলুম না। তাছাড়া বর্তমান ভারতের সাধারণ মানুষ এত কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা দিয়ে ভারী ভারী গবেষণামূলক বই কিনবেই-বা কী করে? কারণ, সংসার-চালানোর জন্য মাসে ন্যূনতম ১০,০০০০ টাকা রোজগার করতেই যেখানে বর্তমান সাধারণ ভারতবাসীর জিভ বেরিয়ে যায়!
আরও পড়ুন: চিঠিপত্রের আলোকে সুভাষচন্দ্র বসু ও চিত্তরঞ্জন দাশ

সেই শৈশব থেকেই ২৬ জানুয়ারির চেয়েও ‘২৩ জনুয়ারি’ আমাকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি টানে। শৈশব-কৈশোরের মতো আজও ২৩ জানুয়ারি আসলেই এই মানুষটির জন্য অজস্র মনখারাপ, অসংখ্য প্রশ্ন, সীমাহীন কৌতূহল আমার মনকে সমুদ্রের ঢেউয়ের আঘাতের মতো তোলপাড় করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই মানুষটির আপাত পরাজয় সত্ত্বেও বিজয়ের মহান সম্মান, যা তিনি পেয়ে চলেছেন, তা বাঙালি হিসেবে আমাকে গৌরাবান্বিত করে।
সেই কোন কিশোরবেলা থেকে বাজারি সংবাদপত্রে যেখানে যত তাঁর উপর আর্টিকেল প্রকাশিত হত, হাতে পাওয়া মাত্রই এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলতাম। ওই কৈশরেই আমার মেসোর লাইব্রেরির কালেকশন থেকে পড়ে ফেলেছিলাম শ্যামল বসুর ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’ বইটা। কিন্তু যেটা বলতে চাই না, তার হল— ওই বইটা পড়ে নিভৃতে চোখের জল ফেলেছিলাম। তবুও বলতে দ্বিধা নেই, আজকের মতো সেদিনও কোনও স্বপ্ন দেখিনি নেতাজি গবেষক হওয়ার। আসলে এই সব পাগলামো আজও রয়ে গেছে নেতাজির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, আবেগ ও একান্ত ভালোবাসার খাতিরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতন যুদ্ধে যেখানে হিটলারের মতো তিনিও হেরে গিয়েছিলেন, কিন্তু বাঙালি তথা ভারতবাসী তো বটেই, এমনকী সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ঘৃণা তো নয়ই, উল্টে বরং হিটলারের বিপরীতে গিয়ে তাঁকে বিজয়ীর সমান সম্মান শ্রদ্ধা ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জয় এখানেই। বলতে গেলে, ওঁর এই করিশ্মার জন্যই সারা পৃথিবীর সাধারণমানুষ তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সিংহাসনে বসিয়েছে।
আরও পড়ুন: কালিন্দীর কূলে

সেই শৈশব থেকে পরিবারের বড়দের মুখ থেকে শুনে আসা ‘নেতাজি আজও বেঁচে আছেন?’, ‘গুমনামী বাবাই নেতাজি’, সঙ্গে কৈশোরে পড়া ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’— সবমিলিয়ে মানুষটির বীরত্ব, শৌর্যবীর্য, করিশ্মা, অজস্র প্রশ্ন, অপার রহস্য আমাকে আজও মোহিত করে তোলে। সেই আশির দশকের শেষে, বাংলার অন্যতম এক বহুল প্রচারিত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য খুব মন দিয়ে পড়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, লেখক লেখক বরুণ সেনগুপ্ত। বেশ ঠোঁটকাটা চ্যাটাং চ্যাটাং লেখা— সরকারের বসানো প্রতিটি কমিশনের রিপোর্টকে তুলোধোনা করতে দেখেছি। বিগত দশকের মাঝপর্বে এই লেখাটি আবারও পুনঃপ্রকাশিত হয়। হয়তো ভবিষ্যতে আবারও হতে পারে। যাই হোক, যতবারই প্রকাশিত হবে, ততবারই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মন দিয়ে পড়ব। যদিও আমার এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় গুগল-এ দেখলাম এই লেখাটি এখন গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছে। খুব চেষ্টা করব অদূর ভবিষ্যতে এই বইটি নিজের সংগ্রহে রাখতে। এই লেখাগুলি ছাড়াও, একটা পর্যায়ে GUMNAMI BABA A Case History এবং শৈলেশ দে-র ‘আমি সুভাষ বলছি’ বইগুলো হাতে এসেছিল। নাহ্, নিজের জ্ঞানমাহাত্ম্য এখানে আমি প্রচার করতে বসিনি। আসলে, একজন নেতাজির ভক্ত হয়ে মনে জন্ম নিয়েছিল পাহাড়-প্রমাণ প্রশ্ন। এই প্রতিবেদনে তো সব প্রশ্ন তুলে ধরা সম্ভব নয়, কিন্তু কিছু প্রশ্ন তো না-বললেই নয়…
দেশের যাবতীয় সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তো জনগণের টাকাতেই হয়। সুতরাং ১৯৪৭-এর পর থেকে নেতাজির মৃত্যুরহস্য উন্মোচন বা গুমনামী বাবাই নেতাজি কি না, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি কমিশন বসানো হয়েছিল। এই কমিশনগুলোর চালানোর অর্থ সরকারই নিজে হাতে জুগিয়েছিল— তা তো জনগণের টাকা নিয়েই। সুতরাং গবেষণামূলক গভীরে না-গেলেও মোটের উপর একটু সিরিয়াস অনুসন্ধান করলে বেশ বোঝা যায়— আজ পর্যন্ত যা-যা কমিশন বসেছে (নেতাজি সংক্রান্ত) সেখানে যেন এক অদৃশ্য নির্দেশনামা দেওয়া হয়েই থাকে— যাই করো আর বলো না বাপু, শেষমেশ তোমাকে বলতেই হবে ‘তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল’ অথবা ‘গুমনামী বাবা নেতাজি নয়’।
আরও পড়ুন: কেবল ঈশপের গল্পই নয়, নীতিবোধ শেখাত বাঁটুলও

নিন্দুকদের অভিযোগ, সরকারপক্ষের যে অদৃশ্য কালো হাত নেতাজি-সংক্রান্ত কমিশনগুলোতে কাজ করে, তা বেশ বোঝা যায় মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টটি দেখলে। এই কমিশন তার রিপোর্টে প্রমাণসাপেক্ষে তো বলেই দিয়েছে তাইহোকুতে সেইদিন কোনও বিমান দুর্ঘটনা হয়নি। সুতরাং ওইদিন বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু গুমনামী বাবাই নেতাজি কি না, সেই সম্পর্কে অনেক পজিটিভ তথ্য থাকলেও শেষপর্যন্ত জাস্টিস মুখার্জি পরিষ্কার জানিয়ে দেন— গুমনামি বাবা নেতাজি নন। রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে অন ক্যামেরায় তিনি তাঁর রিপোর্টে স্বপক্ষে কথা বলেন। কিন্তু অফ ক্যামেরায় গুমনামী বাবার প্রসঙ্গে তিনি আলটপকা সত্যটা প্রকাশ করে দেন: “…believe me, এটা আমি personally বলছি, কাউকে বলবেন না, I am hundred percent sure উনিই হচ্ছেন নেতাজি।” জাস্টিস মুখার্জির এই কথাটা বলার সময় ক্যামেরা সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশত ক্যামেরা অন ছিল। নিন্দুকদের অভিযোগ, সরকার নাকি এই ভিডিয়োটার এই অংশ জাল প্রমাণ করতে ব্যস্ত।
২০১৬-এর বিষ্ণু সহাই রিপোর্টও অনেকটা তাই। যেখানে সামান্য কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ সাক্ষীই বলেছেন গুমনামী বাবার সঙ্গে নেতাজির মুখের অসম্ভব মিল। ভগবানজির ঘর থেকে নেতাজির এমন বহু জিনিস পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে নেতাজির পারিবারিক চিঠিপত্র। শুধু তাই নয়, এই কমিশন রিপোর্ট দিয়েছিল গুমনামী বাবার গলার স্বরের সঙ্গে নেতাজির কণ্ঠস্বরের অসম্ভব মিল!
আরও পড়ুন: কলকাতা ডার্বি আর বাঁটুলের বাঙালি সুপারম্যানের স্বীকৃতি প্রাপ্তি

কিন্তু ওই… গলার স্বর-সহ সাক্ষীদের অধিকাংশের জবানিতে গুমনামী বাবার সঙ্গে নেতাজির মুখের মিল থাকলেও এবং সেখানে নেতাজির পারিবারিক ছবি-সহ চিঠিপত্র ও নানান জিনিসপত্র থাকলেও কমিশন সরকারের অদৃশ্য হাত ধরে থেকেছে— এমনটাই অভিযোগ বেশকিছু নেতাজি অনুরাগী, শখ বা জীবন দিয়ে তৈরি হওয়া দেশের নাগরিকদের।
পথচলতি অতি সাধারণ মানুষের কথা কানে আসে। বিশেষ করে ২৩ জানুয়ারি এলে। আমার কোথাও মনে হয়েছে নেতাজি-সংক্রান্ত সরকারের কমিশনগুলোর রিপোর্টে সাধারণ মানুষ খুশি না, অবিশ্বাস করে। কারণ ওই যে বললাম, দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে জনগণের মনে অন্তর্দৃষ্টির এক হার্ড-ইমিউনিটি আপনা-আপনি তৈরি হয়ে গেছে। যেটা মনে হয়েছে, তা হল, ভোটে জিতে আসার আগে যে রাজনৈতিক দলই প্রো-নেতাজি সাজুক না কেন, ভোটে জিতে আসার পর তাকে অ্যান্টি-নেতাজি সাজতেই হবে— বিশেষ করে গুমনামী বাবাকে নেতাজি হিসেবে অস্বীকার করা এবং তাইহোকুতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে (তা সে যতই এই দুর্ঘটনাটার বিরুদ্ধে প্রমাণ থাকুক না কেন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারত থেকে ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াটা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এখানে মনে রাখতে হবে শেষপর্যন্ত ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়াটা ভারতবর্ষের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে ফয়সালা হয়নি। এদেশে ইংরেজির যে তাঁবেদার ছিল তাদের সঙ্গেই চুক্তি হয়েছিল ভারতকে ‘স্বাধীনতা’ দেওয়ার। আসলে নেতাজি ছিলেন চরম শত্রু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধপরাধী হিসেবে এমনিতেই নেতাজির ওপর খাঁড়া ঝুলেছিল, যা আজও অব্যাহত। এই আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কে আশ্রয় দেওয়া!!!— এই ধক স্বীকার করার বা সামলানোর ক্ষমতা ভারতের সরকারি কোনও রাজনৈতিক পার্টির নেই। কারণ প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক-রাষ্ট্রীয় স্তরে জটিল আইনে ফেঁসে যাবে— সে-হ্যাঁপা সামলাবে কে?
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল কংগ্রেস আমলে নেতাজি-সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য সম্পূর্ণ নষ্ট বা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুমনামী বাবার ব্যাপারে যে বই আর সংবাদ রিপোর্টগুলো করেছি, সেখানেও পেয়েছি কার্ল বাগেটের কথা। হাতের লেখা পরীক্ষা করার ব্যাপারে তাঁর ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা, ৫০৯টি মামলায় তাঁর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। গুমনামী বাবার হাতের লেখার সঙ্গে নেতাজির হাতের লেখার একশো শতাংশ মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। বাগেট তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন গুমনামী বাবা ও নেতাজি আলাদা কোনও ব্যক্তি নন। চন্দ্রচূড় ও অনুজ ধরের বই ‘কাউনড্রাম: সুভাষ বোস’স লাইফ আফটার ডেথ’ বইটিতে দেখতে পাই ১৩০টি চিঠিপত্র আছে গুমনামী বাবার হস্তাক্ষরে। এইসব চিঠি তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে লিখেছিলেন নেতাজি ঘনিষ্ঠ পবিত্রমোহন রায়কে। পবিত্রমোহন রায়কে গুমনামী বাবা চিনলেন কী করে?
আরও পড়ুন: বোর্ডিং যখন বোরিং নয়: নন্টে ফন্টে আর নারায়ণ দেবনাথের গল্প

কেন কীসের এত ভয়? স্বাধীনতার প্রশ্নে ইংরেজদের সঙ্গে আপস মীমাংসার মতো কোনও অন্যায় বা পাপকর্মে যুক্ত থাকার ইঙ্গিত?—আসলে, নেতাজির বিষয়ে আমার বাসা বানানো জনগণের মনের এই অসম্ভব প্রশ্ন যা আসলে আমার cognitive development-এ এক প্রকারের উত্তরণ ঘটেছে, যেখানে প্রকাশ পায় এক সন্দেহজনক অন্তর্দৃষ্টির।
এই তো বছরখানেক আগে। ২২ জানুয়ারি ২০২১। ‘এই সময়’ পত্রিকা-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নেতাজি গবেষক পূরবী রায়। তিনি এক জায়গায় বলছেন: “আমার ধারণা ছিল ১২৫ তম জন্মজয়ন্তীতে এসে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু কোনও উত্তর মিলল না। আমি নিশ্চিত, বর্তমান সরকারের কাছে উত্তর আছে। নেই কোনও রাজনৈতিক কারণ বা আন্তর্জাতিক কারণ অথবা কোনও অর্থনৈতিক কারণ— এমন একটা কারণ তাদের থমকে রেখেছে যে, তারা কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না।”
তাহলে বুঝতেই পারছেন, আমার বা আমাদের মতন সাধারণ নাগরিকদের, (বিশেষ করে নেতাজি বিষয়ে) cognitive development-টা ঠিক কোন রেঞ্জে পৌঁছে যায়, কখনও কখনও গবেষকদের চিন্তার কাছাকাছি স্তরে এসে যায়!
এই সাক্ষাৎকারটিতে পূরবী রায় আর-এক জায়গায় বলেছেন: “আমি যতখানি দেখছি, অনেক ফাইল নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু ফাইল চলে গিয়েছে মোহাম্মদ ইউনুস-এর কাছে। আবার অনেক ফাইল রয়েছে রাধাকৃষ্ণনের ছেলে গোপালের কাছে। এখনও সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার ফাইল বাকি আছে। বলছি না যে, ফাইলই উত্তর দেবে। আমার দৃঢ় ধারণা, উত্তর ওঁদের হাতে এসে গিয়েছে।’’
বছরখানেক আগেই, বাংলার সর্বোচ্চ টিআরপি প্রাপ্ত এক টিভি চ্যানেলে এসেছিলেন ‘গুমনামী বাবা’ সিনেমাটির পরিচালক ও মূল চরিত্রের অভিনেতা। এসেছিলেন নেতাজির রক্ত সম্পর্কীয় খুব কাছের আত্মীয়, যিনি আবার গবেষক ইতিহাসবিদ। দেখলাম নেতাজির ওই গবেষক আত্মীয়টি বিদ্যার ঔদ্ধত্যের আগুনে সিনেমাটির পরিচালক ও চরিত্রাভিনেতাকে পুড়িয়ে দিতে। সঞ্চালককে দেখলাম ঔদ্ধত্যের প্রতি প্রশ্রয় চাহনি। ভাবখানা এমন রক্তের সম্পর্ক বলেই নেতাজির মতো মহান একজন পার্সোনালিটির ঠিকেদারি একমাত্র উনি নিয়েছেন। আর সবাই বোকা মূর্খ অজ্ঞ, সেখানে গুমনামী বাবা লোকটা নিছক ‘ফেরেববাজ’ বা ‘খুনে অপরাধী’। কোনও কোনও গবেষকদের অভিযোগ কানে এসেছে— নেতাজির নামে কলকাতার গবেষণা কেন্দ্রটি যেটি নাকি মিত্রশক্তির পয়সাতে চলে, যারা নাকি নেতাজিকে আন্তর্জাতিক ওয়ারক্রিমিনাল হিসেবে নিদান দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: শৈশব-কৈশোর জুড়ে থাকা কিছু বাঙালি কমিক স্ট্রিপ ও নারায়ণ দেবনাথ

আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী। অথচ নরম, চরম উভয় বামপন্থীদের মুখে শুনে আসছি তিনি নাকি ‘তোজোর কুকুর’। এখন অবশ্য খুব একটা বলতে শুনি না। প্রবণতাটা কমেছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে মানুষটা জার্মান ও জাপানিদের সঙ্গে হাত মেলানোর আগে রাশিয়ায় স্তালিনের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, শেষে বাধ্য হয়ে না পেরে যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের নিয়ে সেনাদল তৈরি করতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য, আর তাই জন্য তাঁকে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল যার জার্মান ও জাপানিদের সঙ্গে হাত মেলানো— এর মধ্যে কি এমন অন্যায় রয়েছে আমি তো কিছু বুঝি না। না হলে তো লেলিন, স্তালিন, চে গেভারা, হোচিমিন এঁরা সবাই মিথ্যে হয়ে যায়! অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর তো বলতে শুনেছি— আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি যদি… ইতিহাস তাহলে অন্যরকম হত।
যাই হোক আমার দিক থেকে যেটা বলার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৭ বছর পর ভারতের নরম ও চরম বামপন্থীরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে তাদের পায়ের তলার জমিটা শক্ত আছে? আপসের স্বাধীনতা লাভের রূপটাকে সম্ভবত তারা বুঝতে পারছে নিজের দেশের বুকের দিকে তাকিয়ে, আফ্রিকার কলোনিগুলোর আপসকামী মুক্তির দিকে তাকিয়ে…
ও হ্যাঁ, কোনও এক বিদেশি টিভি চ্যানেলে দেখলাম সম্প্রতি তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট খুন হয়েছেন— নিন্দুকদের দাবি, সিআইএ চরেরা নাকি এই অপকর্মটি ঘটিয়েছে। অপরাধ? তিনি নাকি মুরগি, শুয়োর গরুর কফ-থুথু পাঠিয়েছিলেন হু-এর কাছে। ‘হু’ সেগুলো পরীক্ষা করে ঘোষণা করেছে সব রিপোর্ট পজিটিভ, ওই দেশে করোনার অতিমারিতে ছেয়ে গেছে… ভ্যাকসিন দরকার… তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট মুচকে হেসেছিলেন, ভিডিয়োতে আসল সত্য প্রকাশ করে দিয়েছিলেন… অতঃপর…
না, ভারতে কেন, সমগ্র বিশ্বে বিশেষত ইউরোপে-আমেরিকাতে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর খবর মিডিয়া প্রচার করেনি।
এই অনুষঙ্গেই তো স্মরণ করতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির মহান জয়ের কথা! প্রায় ৭৭ বছরে পা দিল সেই যুদ্ধ। এরমধ্যে মিত্রশক্তি তাদের শত্রু দেশগুলোর সঙ্গে আপস মীমাংসা করে নিয়েছে। এদের মাথার ওপর পালের গোদা আমেরিকা।
সারাবিশ্বে ফ্যাসিবাদের রমরমা ঠাউর করা যায়— মানুষের অধিকার থেকে চাকরি সবকিছুই নিম্নমুখী। যে ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা .০-এর থেকেও নীচে সেই ভাইরাসের প্রকোপকে অতিমারি ঘোষণা করা হয়! মানুষকে ভ্যাকসিনের ভয় দেখায়, না-নিলে তাকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে দেওয়া হবে। বিশ্বজুড়ে এরকম মেডিক্যাল ফ্যাসিজম এর আগে কখনও কোনও দেশের নাগরিকরা দেখেনি, একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে ছাড়া। এই তো মিত্রশক্তি!
আরও পড়ুন: শাঁওলি মিত্রকে মনে রেখে

করোনার ভাইরাস নয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলির হিংসার ও অমানবিকতার মরণব্যাধিটি অতিমারি হিসেবে ভারতেও সংক্রমিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশের মানুষকে চাকরির জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ওপরই নির্ভর করতে হয়। সত্যিই তো, আমেরিকার কর্পোরেটরা এগিয়ে না-এলে দেশের মানুষ একটা ভদ্রস্থ চাকরি পাবে কি করে? বাংলা তথা দেশের অন্যান্য ভাষাগুলো তো আর কাজের আর বিজ্ঞানের ভাষা হয়ে উঠল না! ইরানের কাছ থেকে তেল কিনবে কী কিনবে না সেটার জন্য আমেরিকার অনুমতি নিতে হয়। অলাভজনক কৃষিক্ষেত্রকে আমেরিকার কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে না-দিলে আমাদের কৃষিক্ষেত্র বাঁচবে কী করে?
হায় ‘স্বাধীন’ ভারতবর্ষ! তাই জন্যই তাইহোকুতেই নেতাজিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়, বারবার, শত অ-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও।