হেমসাগর লেন: একজন বৈরাগ্যমালার স্মৃতিচিহ্ন

তুষার শুভ্র বাসাক (বাংলাদেশ)
বাংলাভাষায় যে পাঁচজন কবি কবিতার পাশাপাশি সংগীতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন রজনীকান্ত সেন। সেই রজনীকান্ত সেনের বংশধর তথা নাতনি হলেন কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। যাঁর অনবদ্য অভিনয়-দর্শক-হৃদয়ে আজও দাগ কেটে আছে, থাকবে চিরকাল।
ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহাকুমার বেলকুচি থানার অন্তর্গত সেন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রাম ছিল রজনীকান্ত সেনের পৈতৃক নিবাস। পরবর্তীতে রজনীকান্তের পুত্র ও সুচিত্রা সেনের পিতা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা জেলা শহরের গোপালপুর এলাকার হেমসাগর লেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ছিলেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক। তাঁর স্ত্রী ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহকর্ত্রী। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল, পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যারূপে তাঁর ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন কোটি হৃদয়ের লক্ষ্মী, মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। পিতৃস্নেহে ও মাতৃআঁচলে বেড়ে ওঠা সুচিত্রা সেনের জন্মগত নাম রমা দাশগুপ্ত। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি।
আরও পড়ুন: আমি, গাছ, ফুল ও উত্তম কুমার

রমা দাশগুপ্ত এই পরিচয়ে তিনি পাবনায় পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু সাতচল্লিশের দেশভাগের পর সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। বয়স যখন ষোলো, জামা ছেড়ে শাড়ি পরতে শুরু করেছেন ঠিক তখনই শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন। মালাবদলের আনুষ্ঠানিকতায় পালাবদলের মাধ্যমে দাশগুপ্ত থেকে হয়ে ওঠেন সেন।
এদিকে সুচিত্রা সেনের পাবনার পৈতৃক নিবাস পরিণত হয় বিরানভূমিতে। শত্রু সম্পত্তি আখ্যায়িত করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই নিবাস-সম্পত্তি দখল নেয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে পুনরায় সুচিত্রা সেনের এই পৈতৃক নিবাস দখল নেয়। তথ্যমতে, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ইমাম গাযযালী ইন্সটিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এক বছরের জন্য এই অর্পিত সম্পত্তি লিজ নেয়। এর মাধ্যমে সুচিত্রা সেনের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের দখলে চলে যায়।
আরও পড়ুন: চিরকুমার উত্তম-ফুটবল

২০০৯ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলার স্থানীয় প্রশাসন সেই বাড়িটি দখলমুক্ত করার জন্য আবেদন করে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হলে আদালত সেই নির্দেশ স্থগিত করে। পরবর্তীতে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান পুনরায় বাড়িটি দখলমুক্ত করার জন্য ‘ইমাম গাযযালী ইন্সটিটিউট’-এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই, সকল দ্বিমত-বিবাদ আর জটিলতার কাঁটাতার কেটে বাড়িটি দখলমুক্ত হয়। দখলমুক্ত করার পাশাপাশি উচ্চ আদালত বাড়িটিতে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের আদেশ দেয়।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সুচিত্রা সেনের পৈতৃক নিবাসে ‘কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাবনা জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই সংগ্রহশালাটি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ১০ টাকা প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেখানে সুচিত্রা সেনের নানা সময়ে তোলা ৪৬টি স্থিরচিত্র, বিলবোর্ড, পুস্তিকা-স্মরণিকা ও পারিবারিক নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রিক স্থান পেয়েছে। ‘সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ’-এর তথ্যমতে, বাড়িটির প্রবেশদ্বারের সম্মুখে সুচিত্রা সেনের একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। বাড়ির ভেতরের দিক নানাজাতের ফুলের সৌন্দর্যে সুসজ্জিত।

পাবনা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র সংসদ’ এই কালজয়ী মহানায়িকাকে ঘিরে পাবনা শহরে সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসব পালন করে। সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্র জগতের বিস্ময়; তাই তাঁর অভিনয় নিয়ে গবেষণা, আলোচনা ও শেখার অনেককিছু আছে। এইজন্য এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের।
বাড়ির মতো নিজের সাজ-সজ্জাতে সুচিত্রা সেনের রুচি দৃষ্টিকে তৃপ্তি দেয়। এক অপরূপ স্নিগ্ধতা তাকে ঘিরে থাকে। সুচিত্রা সেন অত্যন্ত সাধারণ তাঁতের শাড়ি অথবা কোনও সিনথেটিক শাড়ি পরতে অধিক পছন্দ করতেন। তিনি গলায় একটি সরু সোনার চেন এবং সবসময়ের জন্য নাকে ছোট্ট একটি হিরের নাকছাবি পরতেন। দুই হাতে থাকত কাচের চুড়ি, যা তার সাজসজ্জা ও ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বিয়ের পর সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্রে আসেন। তাঁর অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘শেষ কোথায়’ (১৯৫২) শুভমুক্তি না পেলেও মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) চলচ্চিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয়, তাঁকে দর্শক-হৃদয়ে স্থান দিয়েছে কিংবদন্তি হিসেবে। সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয় করার পর তিনি ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেন। এরপর দীর্ঘ ৩৬ বছর লোকচুক্ষ হতে আত্মগোপনে থেকে তিনি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার বেল ভিউ হসপিটালে (ভারতীয় সময় অনুযায়ী সকাল ৮টা ২৫ মিনিট) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে স্মরণ করে বলব…
ভূরিভূরি প্রতিভায় গাঁথা মালা তুমি,
সৌন্দর্য গন্ধে বিমোহিত সংসারী,
জীবনযজ্ঞ তোমার রুদ্রাক্ষের মতো বৈরাগ্য,
স্তুতি-চিত্তে দৃষ্টিনন্দিত নিবেদিত সাহসী।
অতঃপর পরিশেষে
ক্রান্তির সংক্রান্তিকালে যজ্ঞে দেওয়া শেষ ঘৃতাহুতি,
মায়া-ভক্তির সনাতনী-চেতনায় অশ্রু নির্বাসন।
চমৎকার