পাওলো রোসি: মনে পড়া কিছু কথা

ড. উজ্জ্বল রায়
ক্লাসে ঢুকে নিমাইসাধন স্যার (বসু) উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, “কাল তোমরা দেখছ ফাইনালটা। কি দারুণ খেলল দেখলে ইতালি। বিশেষ করে পাওলো রোসি।” সেটা ছিল ১৯৮২ সাল। আমি ছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে দুই শিক্ষকের ফুটবল প্রীতি সর্বজনবিদিত ছিল। অধ্যাপক নিমাই সাধন বসু এবং পি কে বি অর্থাৎ প্রঞ্জলকুমার ভট্টাচার্য স্যার। এই দুই স্যারের ফুটবলপ্রেমের সঙ্গে একটি অদ্ভুত বিষয় ছিল এঁরা দু’জনে দু’টি দল মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক ছিলেন। নাহ এটার মধ্যে তেমন আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। দুই বন্ধু বা সহকর্মী তো দুই দলের সমর্থক হতেই পারেন। কিন্তু আমাদের দুই স্যার দুই ক্লাবের একদিনে খেলা থাকলে একইসঙ্গে ক্লাসের পাট চুকিয়ে গাড়িতে ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন। তারপর আকাশবাণীর কাছাকাছি গিয়ে যে যাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন।
আরও পড়ুন: সেই ফ্যালফ্যাল করে তাকানোটা রয়েই গেল

যাই হোক ফিরে আসি ’৮২-তে। পাওলো রোসিতে। হ্যাঁ, পাওলো রোসি কেই বেশি মনে আছে সেই বিশ্বজয়ী দলের। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং পশ্চিম জার্মানির মতো দেশকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া বলে কথা। বিশেষত, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে তাঁর করা হ্যাটট্রিক তো আমাদের চমকে দিয়েছিল। স্পেনে অনুষ্ঠিত ’৮২ বিশ্বকাপে কিছু ম্যাচ সরাসরি এবং কিছু বিলম্বিত সম্প্রসারণ করেছিল দূরদর্শনে। যদিও আমার স্কুলজীবনে কিছু আন্তজার্তিক ফুটবল দেখার সুযোগ মিলেছিল। বাবা যেহেতু ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই বিশেষ করে মনে পড়ে প্রেস ক্লাবে বসে বড় পর্দায় ১৯৭৪ সালের সেই ঐতিহাসিক ফাইনালের ভিডিয়ো রেকর্ডিং যাকে ফুটবল বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছিলেন যোহান ক্রুয়েভ বেকেনবাওয়ারের লড়াই বলে। কিন্তু সুযোগসন্ধানী গার্ড মুলার গোল করে পশ্চিম জামার্নিকে খেতাব এনে দিয়েছিলেন। তবে আমবাঙালির বিশ্বফুটবলের প্রথম স্বাদগ্রহণ কিন্তু সেই ’৮২-র বিশ্বকাপের সময়ই। সেই পাওলো রোসি, যিনি ফাইনালে জার্মানদের গোলে প্রথম বল ঢুকিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ ঘোষ: ফ্ল্যাশব্যাকে আশির দশকের কলকাতা ফুটবল দুনিয়া

তাই ’৮২-র পাওলো রোসিকে বাঙালির বিশেষত, যাঁরা আন্তর্জাতিক ফুটবলের একটু আধটু খবর রাখেন, তাঁদের ভুলে যাওয়া কঠিন। এই বছরটা সত্যিই ভীষণই আশঙ্কার বছর। কত বিশিষ্ট মানুষ আচমকা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। প্রায় সব ফিল্ডের মানুষ। চলে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হরি বাসুদেবন। কয়েকদিনের ব্যবধানে খবর পেলাম বাঙালির তিন আইডল পিকে, চুনী আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নেই। এখন খবরের যুগ। কম্পিউটার খুললে খবর। মোবাইলে খবর ভেসে আসে ওয়েবের সৌজন্যে। আজকাল খবর আসে শব্দের থেকেও দ্রুত গতিতে। কয়েক দিন আগে খবর পেলাম মারাদোনা নেই। আজকের খবর পাওলো রোসি আমাদের মধ্যে নেই। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে যায়। ক্রমশ যেন ঝাপসা হতে থাকছে আমাদের কৈশোর, যৌবন। তবু দিন এগিয়ে চলে। বেঁচে থাকে সুখস্মৃতি। নীল স্মৃতিময় ঝাঁকড়া চুলের রঙিন নায়ক পাওলো রোসি।
নিবন্ধক সোনারপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ
Fantastic Article. Wonderful memoir Sir.