পার্বতীনাথ শিব মন্দির, উত্তর গোবিন্দনগর (থানা- দাসপুর, মেদিনীপুর)

চিন্ময় দাশ
সমগ্র ঘাটাল মহকুমা জুড়ে ছোট-বড় অনেকগুলি নদ-নদীর সমাবেশ। তার সঙ্গে আছে প্রশস্ত কয়েকটি খালও। একসময় এই নদী আর খালগুলি ছিল পরিবহণ আর সেচের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষত নিকাশির কাজে খালগুলির ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, কৃষির উন্নতি বিধান এবং ক্ষয়-ক্ষতি রোধের প্রয়োজনে খালগুলি সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হয়েছিল।
কয়েকটি নদীর অববাহিকা হওয়ার কারণে, দাসপুর থানার সমগ্র এলাকা উর্বর কৃষিপ্রধান। কৃষিজ পণ্য, নীল-চাষ আর বিশেষ করে রেশম শিল্পের উৎপাদনের সুবাদে, সপ্তদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে, এই থানার আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল লক্ষ্যণীয়ভাবে। বহুসংখ্যক জমিদার ও ধনী পরিবারের উদ্ভব ঘটেছিল এই থানায়। তার সঙ্গে, সোনায় সোহাগার মতো অনেকগুলি মন্দির-নির্মাতা সূত্রধর পরিবারের বসবাসও গড়ে উঠেছিল দাসপুরে। অর্থবান পরিবার আর দক্ষ কারিগর― দুইয়ের মেলবন্ধনে, একের পর এক, বহুসংখ্যক দেবালয় গড়ে উঠেছিল গ্রামে গ্রামে। একটি থানায় এত বিপুল সংখ্যক মন্দিরের সমাবেশ, বোধকরি বাংলার অন্য কোথাও দেখা যাবে না।
আরও পড়ুন: রামজি মন্দির, রামবাগ (থানা- মহিষাদল, মেদিনীপুর)

একটি শিবের মন্দিরের প্রসঙ্গে এত দীর্ঘ ভূমিকার একটি কারণ আছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে, নদী-খাল সংস্কারের সময়, বহু মন্দির নষ্ট করে ফেলা হয়। নদীর বাঁধ সংস্কারের সময়, মন্দির নষ্ট করে ফেলবার প্রধান দৃষ্টান্ত দেখা যায়, মেদিনীপুর সদর কোতওয়ালি থানার পাথরা গ্রামে। সেখানে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির কোনওটা সম্পূর্ণ, কোনওটাবা একাংশ, মাটির নিচে চাপা পড়ে, একেবারেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।
একই দৃষ্টান্ত দেখা যায় দাসপুর থানাতেও। দু’টি উদাহরণ দেওয়া যাক― ১. এই থানার পলাশপাই খাল (প্রকৃতপক্ষে সেটি কংসাবতী নদীর পূর্ববাহিনী শাখা) সংস্কারের সময়, গ্রামের মাইতি বংশের অনিন্দ্যসুন্দর বিষ্ণু মন্দিরটির সিংহভাগ মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। টেরাকোটা ফলকে মোড়া ছিল সেই দ্বিতল মন্দিরের সর্বাঙ্গ। ২. দ্বিতীয় উদাহরণ, মোহনখালি খালের পাড়ে স্থাপিত পার্বতীনাথ নামের একটি শিব মন্দির। মাটির তলায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে এই মন্দিরের অর্ধেকের বেশি অংশ। এই মন্দিরটি নিয়েই আমাদের আজকের প্রতিবেদন।
আরও পড়ুন: হেমসাগর লেন: একজন বৈরাগ্যমালার স্মৃতিচিহ্ন

একটি প্রতিষ্ঠা লিপি আছে মন্দিরে― “শ্রীশ্রী ভুবনেস্বর/ দেবাদিদেব মহাদেব/ সকাব্দা ১৭৭২ সন ১২৫৭ সাল/ তাং ২১ ভাদ্র মিস্ত্রি/ শ্রী আনন্দরাম দাস/ সাকিম দাসপুর”। (বানান হুবহু) অর্থাৎ মন্দিরটি প্রায় পৌনে দু’শো বছর পূর্বে, ইং ১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠার সময়কাল জানা গেলেও ফলক থেকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার নামটি জানা যায় না। স্থানীয় প্রবীণদের কেউ বলেন, মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন চেতুয়া-বরদা পরগনার রাজা শোভা সিংহ। তবে, এটি মান্য করা যায় না। কারণ, শোভা সিংহ ১৮০০ সালের পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় অভিমতটি হল― শোভার সহোদর ভাই হিম্মত সিংহ রাজস্ব জমা করতে অসমর্থ হলে তাঁকে উচ্ছেদ করে বাংলার নবাব বর্ধমানের রাজাকে এলাকাটির ভার দিয়েছিলেন। বলা হয়, প্রজাবর্গের ধর্মাচরণের জন্য, বর্ধমানের রাজাই মন্দিরটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। আমরা এই দ্বিতীয় মতটিকে গ্রহণ করতে পারি।
আরও পড়ুন: গঙ্গার পলিতে পুষ্ট কলকাতার লৌকিক গান

মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, সেবাপূজা পরিচালনার জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি এবং পুরোহিত, পরিচারক, মালাকার, ঢাকি, নাপিত ইত্যাদি কর্মীদের জন্য জায়গীর-জমি দেওয়া হয়েছিল। কর্মীরা সম্পত্তিগুলি অধিকার করে নিয়েছেন, কিন্তু পুরোহিত এবং পরিচারক (এখানে এই পদের নাম― ব্যোছাতি) ছাড়া, অন্যেরা পূজার কাজে যুক্ত থাকেননি। গ্রামবাসীগণই একটি কমিটি গড়ে, সেবাপূজার ধারাটি টিকিয়ে রেখেছেন।

নিত্যপূজা ছাড়া, ভক্তেরাও প্রায়ই আসেন মানত ইত্যাদির পূজা নিয়ে। মন্দিরটি ‘সাত ভাগের মাড়ো’ নামে পরিচিত। চৈত্র সংক্রান্তিতে ৯ দিনের গাজন উৎসব হয় বিপুল আড়ম্বরে। মাটির তলায় অর্ধের বেশি অংশ চাপা পড়ে গেলেও মন্দিরটি যে এখনও পরিত্যক্ত বা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তার একমাত্র কারণ, এই পূজা এবং উৎসবের ধারাটি টিকে থাকা।
ইটের তৈরি, পশ্চিমমুখী, ‘আট-চালা’ রীতির মন্দির। সাড়ে ১৭ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের বর্গাকার সৌধ, উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট। সামনে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ যুক্ত অলিন্দ, পিছনে এক-দ্বারী গর্ভগৃহ। মন্দিরের ছাউনির চালাগুলির নিচের প্রান্ত বা কার্নিশের বঙ্কিমভাবটি বেশ মনোরম। শীর্ষক অংশে বেঁকিটি একটু প্রলম্বিত। তার উপর আমলক, কলস, ত্রিশূল-দণ্ড স্থাপিত।

বহুসংখ্যক টেরাকোটা ফলক দিয়ে মন্দিরটি সাজানো হয়েছিল। তিনটি দ্বারপথের মাথার উপর তিনটি বড় প্রস্থে, কার্নিশের নিচে সমান্তরাল একটি সারিতে এবং দুই কোনাচ বরাবর দু’টি খাড়া সারিতে ফলকের বিন্যাস হয়েছে। সবই পূরাণ-কথা নির্ভর।
মোটিফগুলিকে মুখ্যত ৪টি ভাগে ভাগ করে দেখা যায়― ১. রামায়ণ-কাহিনি থেকে― লক্ষণের শক্তিশেল, রামের কোলে অচৈতন্য লক্ষ্মণ, হনুমানের গন্ধমাদন আনয়ন, রাবণের সীতাহরণ, অশোক কাননে বন্দিনী সীতা ইত্যাদি।
২. শিব-কথা থেকে― মহাদেবের মন্দির, সেকারণে, কেন্দ্রীয় দ্বারপথের মাথার উপর বড় প্রস্থটি জুড়ে শিবেরই রাজত্ব। গণেশ-জননী, সিংহাসনে উপবিষ্ট হর-পার্বতী, স্খলিত-বসন শিঙ্গাধারী মহাদেব মূর্তি ইত্যাদি অনেকগুলি ফলক।

৩. কৃষ্ণ-লীলা থেকে― কৃষ্ণ অদর্শনে অচৈতন্য রাধারানি, শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধিকার যুগলমূর্তি, ললিতা সখী, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীগণের বস্ত্রহরণ ইত্যাদি।
৪. মঙ্গলকাব্য থেকে― চণ্ডীমঙ্গলকেই উপজীব্য করা হয়েছে এখানে। ধনপতি এবং শ্রীপতির সিংহল অভিমুখে বাণিজ্যযাত্রা, সমুদ্রবক্ষে কমলে-কামিনী দর্শন ফলক দু’টি উল্লেখযোগ্য।
দু’টি দ্বারপাল মূর্তি আছে গর্ভগৃহের দ্বারপথের দু’পাশে। মন্দিরের গা-লাগোয়া সামনে, টিনের ছাউনি দেওয়া একটি নাটমন্দির আছে, ছবি তুলবার পক্ষে ভারী প্রতিবন্ধক সেটি।

সাক্ষাৎকার
সর্বশ্রী শীতলচন্দ্র মাইতি, সত্য়চরণ গোস্বামী, শচীনন্দন চক্রবর্তী― উত্তর গোবিন্দনগর।
পথ-নির্দেশ
পাঁশকুড়া স্টেশন এবং ঘাটাল শহরের সংযোগকারী পথের উপর গঙ্গামাড়োতলা স্টপেজ। সেখান থেকে মোহনখালী বাঁধের উত্তর পাড় ধরে পশ্চিমমুখে সামান্য দূরে, পথের উপরেই মন্দির। আরও ৪/৫টি প্রাচীন মন্দির আছে এই উত্তর গোবিন্দনগর গ্রামে। খাল পার হয়ে, দক্ষিণ পারে গোবিন্দনগর গ্রাম। সেখানেই গোস্বামীদের বিখ্যাত রাধাগোবিন্দ মন্দির।
ছবি লেখক