দু’হাজার কুড়িতে কুড়িয়ে রাখুন

ড. মাল্যবান চট্টোপাধ্যায়
দু’হাজার কুড়ি অবশেষে বিদায় নিতে চলছে। প্রতিটি বছরই কিছু না ইতিবাচক স্মৃতি রেখে যায় মানবমনে। কিন্তু এই বছর কি আদৌ কোনও ইতিবাচক স্মৃতি রেখে যাচ্ছে আমাদের জন্য, যা আমরা যত্নের সঙ্গে কুড়িয়ে রাখতে পারব?
আরও পড়ুন: ২০২০-র বিস্ময়কর প্রাণী

মধুবনী চিত্রশিল্পী অম্বিকা দেবীর আঁকা
ভাবতে গেলে আমাদের অনেকেরই মনে পড়বে অনেক পরিজন বিয়োগের কথা। এই বিয়োগের ধারা আজও চলছে যদি এর গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। করোনা ভারতে অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনে চরম বিপর্যয় এনেছে, এমনকী ডেকে এনেছে পথেঘাটে মৃত্যুও। কিন্তু এসবের মাঝেও যদি কিছু স্মৃতি রাখতে হয় স্মরণীয় হিসেব, আগামী দিনের জন্য তবে বোধহয় তালিকায় রাখতেই হবে মাস্ককে। যা দুর্লভ থেকে ক্রমে সুলভ হয়েছে এই বছর যত এগিয়েছে তত। রঙের মাধুর্যে সুরক্ষা সরঞ্জাম যে কখন স্টাইল স্টেটমেন্ট হয়ে গেছে, তা বোধহয় আমরা বুঝিনি। আজ ম্যাচিং মাস্কের চক্করে বছরের শুরুতে বাজারে আসা এন নাইনটি ফাইভ থেকে তিন স্তরের মাস্ক— সকলেই এখন সাবেকি মাস্ক। আর আধুনিক মাস্ক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে সুন্দর রঙিন মাস্ক, যাতে কখনও আছে বুদ্ধের প্রতিকৃতি তো কখনও আছে ছোটদের মিকি মাউজ।
আরও পড়ুন: ২০২০-র দশটি অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার

ছবি রাকেশ নাকাশ
তবে এই মাস্কের সঙ্গে সঙ্গে মুখোশে মুখ ঢেকে এসেছে আর এক বিপদ। সেই বিপদের ছবি আমরা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিকবার। ফেলে দেওয়া মাস্কে ডানা বা পা জড়িয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছে অনেক পাখিই। তাই কিছুদিন ধরে চলেছে বিজ্ঞাপন মাস্কের সঠিক ব্যবহার আর তাকে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার বিষয়টি নিয়ে। সঠিকভাবে মাস্ক পরা নিয়ে হয়েছে একাধিক বিজ্ঞাপন, আলোচনা। এসব ছাপিয়ে মাস্ক আজ সুরক্ষা সরঞ্জাম থেকে হয়ে উঠেছে সাজসজ্জার অঙ্গ। কলকাতা ময়দানে খেলা বিশেষত ফুটবল বন্ধ হল সেই সুদূর ’৪৬-এর ১৬ আগস্ট থেকে স্বাধীনতার পরের দিনের মধ্যের বিরতির পরে। খেলা বন্ধ হলে কী হবে, শহর জুড়ে এমনকী রাজ্যজুড়ে দেখা গেল সবুজ মেরুন বা লাল হলুদ অর্থাৎ মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের রঙের হরেক ডিজাইনের মাস্ক। কোনও কোনওটির ক্ষেত্রে আবার ক্লাবের লোগোও চিপকানো রয়েছে মাস্কের মধ্যে। তাই বলাই যায়, একটি মাস্ক যা আপনি করোনাকালের শুরু দিকে নিয়ে এসেছিলেন তা যত্ন করে রেখেই দিতে পারেন, সময়ের সাক্ষী হিসেবে। রেখে দিতে পারেন ঘরের সুচ-সুতোয় সেলাই করে তৈরি করা প্রথম মাস্কটি। বলা যায় না এটিই আজ থেকে বছর পঞ্চাশ পরে স্থান পাবে ইতিহাসের উপাদানের পাতায়।
আরও পড়ুন: সুধীন-শ্যামল জুটি এবং বাঙালিয়ানায় মোড়া জিঙ্গল বেল

কলকাতা ডার্বির রঙে মাস্ক
ইতিহাসের কথা বলতে মনে পড়বে একটি যান-এর কথা। বিশ শতকের শুরুতে যেটি আধুনিক শখের যান রূপে আমাদের মধ্যে এসেছিল এবং আজও আছে। যানটির নাম সাইকেল। তবে তার এই থাকার মধ্যে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার মহিমা। করোনাকালে এই শতাব্দী প্রাচীন যান আবার ফিরে এসেছে স্বমহিমায়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা শ্রমিকরা যখন লকডাউনে ঘরে ফিরেছেন, তখন অনেক সময় সাইকেলই হয়েছে তাঁদের সম্বল। আবার গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা সীমায়িত হবার জন্য অনেকেই ঝেড়ে-পুছে বের করেছেন সাইকেলকে। বিক্রি বেড়ে আবার এই যান এখন চলছে রাজপথেও। সাইকেলকে রাজপথে চলার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন। গর্বিত সাইকেল আরোহীর কাছে অবশ্যই এই বছর ইতিবাচক। শুধুমাত্র রুটিরুজি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেই সাইকেল যে কতটা কার্যকরী হয়েছে, তা বলতে গেলে বলতেই হবে হোম ডেলিভারি ব্যবস্থার কথা।
আরও পড়ুন: মহামানব যিশু খ্রিস্ট, মানবপ্রেমের ঘনীভূত রূপ

লকডাউন ও পরে তা উঠে গেলেও আমরা অনেকাংশেই ঘরে বসে কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। তাই লোভনীয় খাদ্য থেকে রোজকার আনাজপাতি সবই এখন অনলাইনে লভ্য। ডেলিভারি পার্সন এখন বহু বয়স্ক মানুষের জীবনের অন্যতম গুরত্বপূর্ণ সম্বল। তাঁদের কথা থেকে যাবে কুড়ির ক্যালেন্ডারে। হোম ডেলিভারির এই নতুন সংস্কৃতি আমাদের ঘরের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করছে হয়তো, কিন্তু কমিয়ে দেয়নি আড্ডার সুযোগ। আড্ডার রক ছেড়ে নূতন আর এক জায়গায় মশগুল হচ্ছেন নবীন-প্রবীণরা।
আরও পড়ুন: বিশ্বজনীন ক্রিসমাস উৎসবের কিছু অভিনব উদ্যাপন

হ্যাঁ সেই আড্ডায় নেই চা সিঙারার গন্ধ, নেই আড্ডা সেরে বাড়ি ফেরার তাড়া। কিন্তু আছে, তথ্যের নির্ভেজাল আনাগোনা। হ্যাঁ এই করোনাকালে ভারতে সহ পৃথিবীর সব জায়গাতেই বেড়েছে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে একত্র হবার প্রবণতা। যাতে দেশ কালের বেড়া যাচ্ছে ভেঙে। গুগুল মিট বা জুম-এর প্ল্যার্টফর্ম ব্যবহার করার মাধ্যমে আজ পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে বসেই যে কেউ জুড়ে যেতে পারেন যেকোন স্থানে আড্ডায় বা বিশেষ আলোচনায়। নিউ নরম্যালের চক্করে আড্ডা আবার ভার্চুয়াল জগতের থেকে নেমে আসছে বাস্তবের মাটিতে কিন্তু তাতে ভার্চুয়াল আড্ডার পুরাতন সঙ্গীটি কিন্তু আর বাদ পড়ছেন না। তিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমেই আড্ডায় থাকছেন এখন গুগুল মিট বা জুম-এর হাত ধরে। বিশ্বায়নের সূত্রে এ যেন বাস্তবেই বিশ্বের ঘরের মধ্যে চলে আসা। এসবের সূত্র ধরে আমাদের স্মৃতিতে কিছুটা হলেও থেকে যাবে ভার্চুয়াল যুগের এই স্মৃতি।

ভার্চুয়াল যুগে আমরা কি আর একটু বেশি স্বনির্ভর হয়েছি? আত্মনির্ভর ভারতের কল্পনা কি বাস্তবের দিকে এগিয়েছে? এ নিয়ে ভাবতে গেয়ে এটা বলতেই হবে যে, করোনাকালে আমরা বুঝে গেছি এমন অনেক জিনিসই আছে, যেগুলি আমরা বহুকাল ধরেই অপরিহার্য মনে করতাম, কিন্তু সেগুলি আসলে অপরিহার্য নয়। আমরা অনেকেই কমিয়েছি জীবনযাপনের খরচ। কিন্তু তাতে বাঁচার ইচ্ছাটা আমাদের কারোরই কমেনি। হ্যাঁ এই বাঁচার ইচ্ছাটাই এই বছরের একটা ইতিবাচক দিক, যা প্রতিফলিত হয়েছে গণমাধ্যমগুলিতে। এই বাঁচার ইচ্ছার প্রেক্ষিতে মাঝেমাঝেই আমরা দেখেছি ভ্যাকসিনের ক্ষীণ আশায় শেয়ার বাজার চাঙ্গা হতে, সোনার দর ঊর্ধ্বমুখী হতে। সুরাহার পরশ পাথর খুঁজতে খুঁজতে আমরা কি বাড়াতে পেরেছি মানুষের জীবনের দাম? নাকি বেড়েছে বৈষম্য?

বৈষম্যের প্রতিবাদ হিসেবে যেমন ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ শীর্ষক আন্দোলনের কথা মনে আসবে, তেমনই ভারতের প্রেক্ষিতে মনে পড়বে আর একটি শব্দ, ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। করোনার সূত্রে শিক্ষা যখন অনলাইনে চলে যেতে শুরু করল, তখন থেকে ইন্টারনেট আর দামি মোবাইল না থাকায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে থাকলেন অনেক বিদ্যার্থী। এই বিদ্যার্থীদের কথা উঠে আসতে শুরু করেছিল গণমাধ্যমেই এই বছরের মাঝামাঝি সময়ের থেকেই। ভারতের একাধিক শিক্ষাবিদ তখন থেকেই বলতে থাকেন ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-এর কথা। শিক্ষার সুযোগের এই সীমায়িত হয়ে আসার ভিত্তি যে শুধু আর্থিক, তা কিন্তু নয়। এই সীমায়নের ভিত্তি ভৌগলিকও বটে। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই সর্বত্র ইন্টারনেট উচ্চগতিতে লভ্য নয়, তাই অনেকেই আর্থ-সামাজিক বাঁধা টপকেও ক্লাসের আসতে পারছেন না, নেটওয়ার্কের জন্য। এই সমস্যায় পড়ছেন শিক্ষকও। এই ডিজিটাল পাঁচিল ভাঙার ক্ষেত্রে অর্থ একদিকে যেমন অন্তরায়, অন্যদিকে অন্তরায় অবশ্যই নেটওয়ার্কের অপ্রতুল পরিকাঠামো। তাই এই বৈষম্যের ধরনটাও বোধ হয় আলাদা। এই নতুন বৈষম্যের হাতে হাত মিলিয়ে বাড়ছে দলছুট হবার প্রবণতা, কমছে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা বিদ্যার্থীদের সংখ্যা। এই বৈষম্যের ক্ষতও বোধ হয় কুড়িয়ে রেখে দেবার মতোই।

এবার বৈষম্যের অন্য গল্পে আসা যাক। করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচতে আমাদের হাত সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে ধুয়ে ফেলার যে কথা প্রচার মাধ্যমে উঠে আসছে তার সঙ্গেই জুড়ে আছে এই বৈষম্যের অন্য গল্প। ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে দু’বেলার সম্পূর্ণ আহার যখন নিশ্চিত নয়, তখন স্যানিটাইজার, সাবানের সম্পূর্ণ জোগানও সকলের জন্যে নিশ্চিত করাও কিছুটা অলীক। আর তাই সুরক্ষার অভাব অনুভূত হবে দারিদ্র্য সীমার নীচে থাকা মানুষজনেরই বেশি, এমনতাই ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতে যা হতে দেখা গেল, তার হিসেব বোধ হয় ডারউইন সাহেবের খাতাতেই লেখা থাকবে। ভারত সহ অনেক দেশেই দেখা গেল যে, যারা খুবই দুর্বিষহ পরিবেশের মধ্যে এতকাল থেকে এসেছেন, তারাই কম পরিমাণ আক্রান্ত হচ্ছেন বা আক্রান্ত হয়েও জবরদস্ত লড়াই করে আবার লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়ছেন। বিজ্ঞানীরা উত্তর খুঁজতে গেলেন সেই ডারউইনের কাছেই। বললেন যে, ওঁরা অনেক বেশি প্রতিকূল স্থিতিতেই বেড়ে উঠেছেন এতকাল, তাই এঁদের মধ্যে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করাই ক্ষমতাও বেড়েছে। এও এক বৈষম্যই বটে। তবে এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিল, আমাদের প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না, তার আধারেই নিজেকে গড়ে নিতে হবে। না হলে যোগ্যতমের উদবরতনের নিয়ম মেনে সরে যেতে হবে আমাদের। তাই এই সবের মাঝেও যখন নির্মল প্রকৃতিকে আমরা দেখি তখন এটা বুঝতে পারি, অনেক কম কার্বন সৃষ্টি করেও দিব্যি বাঁচতে পারি আমরা।

শুধু বাঁচতেই নয়, বাঁচাতেও পারি আমরা নিজের উদ্যোগে, অনেককেই। করোনাকালে এরকম উদ্যোগ মাঝেমাঝেই চোখে পড়েছে সকলেরই। সামান্য কিছু অর্থ থেকে লক্ষাধিক টাকা সরকারি তহবিলে দান করেছেন অনেকেই, কেউ চেষ্টা করেছেন নিজের উদ্যোগে কিছু চাল ডাল বিতরণের। আর এভাবেই আমরা ঘরে বন্দি হয়েও নিচ্ছি মানুষের পাশে থাকার পাঠ।

এই পাঠ নিতে আমাদের শেখাচ্ছেন একবিংশ শতকের ফ্লরেন্স নাইটিংগেলরা। প্রসঙ্গত, এই বছরই আমরা পার করলাম ভারতের প্রথম নার্সিং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ইডা সোফিয়া স্কুডারের দেড়শতম জন্মবর্ষ। স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশ্বব্যাপী আত্মত্যাগকে স্মরণ করেছেন বিশ্বের সকল রাষ্ট্রই। অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু শেষ মুহূর্ত অবধি করে গিয়েছেন মানবসেবা। এইভাবেই বাঁচতে শেখার নতুন পাঠ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
ভারতের লাইফলাইন রেলগাড়ির চাকা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা সহজ হয়েছে জীবনযাত্রা। পুরোপুরিভাবে না হলেও চলছে বিমান। করোনা নিশ্চয়ই চলে যাবে, কিন্তু রেখে যাবে অনেক ছবি, অনেক ভিডিয়ো আর লেখাপত্র।

লেখক আসানসোল গার্লস কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
অসাধারন।