রেশম ও তসর শিল্পের সমৃদ্ধ জনপদ আনন্দপুরের রঘুনাথ মন্দির

চিন্ময় দাশ
মেদিনীপুরের কেশপুর থানার মেদিনীপুর আনন্দপুর এককালে সমৃদ্ধ রেশম ও তসর শিল্পের সমৃদ্ধ জনপদ হিসাবে গড়ে উঠেছিল। সেই সুবাদে কয়েকজন জমিদারের উদ্ভব হয়েছিল এই গ্রামে। বেশ কয়েকটি দেবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা। এছাড়া অন্যভাবেও জমিদার হয়েছিল এখানের ‘সরকার’ পদবির একটি পরিবার। কর্ণগড়ের রাজা যশোবন্ত সিংহের দেওয়া সম্পত্তিতে জমিদারি হয়েছিল তাঁদের। পরে, রানি শিরোমণিও কিছু সম্পত্তি দান করেন। সেই সরকার পরিবারও একটি মন্দির গড়েছিলেন। আজ সেই জীর্ণ মন্দিরের কথকতা।
আরও পড়ুন: পুরনো মন্দিরের বর্ধিষ্ণু জনপদ খড়দহ

প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, জমিদারি অর্জন হল কীভাবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। মেদিনীপুর কোতোয়ালি থানায় শিরোমণি গ্রামের বাসিন্দা জনৈক বৈদ্যনাথ সরকার ছিলেন কর্ণগড় রাজার প্রজা। জাতিতে সদগোপ। কর্ণগড়ে তখন রাজা ছিলেন খ্যাতকীর্তি যশোবন্ত সিংহ। তাঁর রাজত্বকাল ইং ১৭১১ থেকে ১৭৪৯ সাল পর্যন্ত। বৈদ্যনাথের ঘরে ছিল অপরূপ সুন্দরী দুই কন্যা— ভবানী এবং শিরোমণি। বংশমর্যাদার কথা ভাবেননি, সাধারণ প্রজার ঘর থেকে ভবানীকে নিজের পুত্রবধূ করে রাজবাড়িতে তুলে এনেছিলেন যশোবন্ত সিংহ। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও ভবানী সন্তানবতী না হওয়ায়, অসাধারণ সুন্দরী কনিষ্ঠা শিরোমণির সঙ্গে অজিত সিংহের বিবাহ দেওয়া হয়। সেটা ১৭৪০ সাল।
আরও পড়ুন: মালঞ্চের ৩০০ বছরের দক্ষিণা কালীর টেরাকোটার মন্দির এখন বয়সের ভারে জীর্ণ

রাজমর্যাদা রক্ষার তাগিদে নিজের বৈবাহিক বৈদ্যনাথকে মোট ৮৩২ বিঘা ‘নিষ্কর’ সম্পত্তি দিয়ে একটি জমিদারিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোবন্ত সিংহ। মহাল ছিল— ভঞ্জভূম পরগনার সংগ্রামগড়, গঙ্গারামবাড়, ভগীরথবাড়, ধামসাই, আকন্দি, লাউড়িয়া প্রভৃতি মৌজায়। বৈদ্যনাথ সরকারের দুই পুত্রের নাম রামচন্দ্র এবং রামকানাই। নিঃসন্তান অজিত সিংহের মৃত্যুতে, রানি শিরোমণি কর্ণগড়ে শাসন ক্ষমতা পেয়েছিলেন। তিনি রামকানাইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র মোহনলালকে বাং ১১৯৮ (ইং ১৭৮৬) সনের ১৬ বৈশাখ ৫৬ বিঘা জমির বন্দোবস্ত দেন। মোহনলালের পৌত্র শিবপ্রসাদ কর্ণগড়ের মায়া ত্যাগ করে আনন্দপুরে চলে আসেন।
আরও পড়ুন: প্রসঙ্গ খড়গপুরের ছটপুজো

সম্ভবত ১২৫ বছরের আরও আগের কথা। শিবপ্রসাদের পুত্র প্রতাপচন্দ্র সরকার আনন্দপুরের একজন খ্যাতনামা জমিদার হয়ে উঠেছিলেন। প্রতাপচন্দ্রই বাংলা সন ১৩০৩ সালে সরকারদের বসতবাড়ি হিসাবে একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। তবে তার পূর্বে, সন ১৩০০ সালে, কুলদেবতা রঘুনাথ জিউর জন্য সুদৃশ্য একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ইটের তৈরি পূর্বমুখী দেবালয়।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের আলুই-রায়পাড়ার শ্রীধর মন্দির

মন্দির-সৌধটি সম্পূর্ণ বর্গাকার। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ ১৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাথার উচ্চতা ৪০ ফুট। মোট পাঁচটি চূড়া এই মন্দিরের। মন্দির-স্থাপত্যের পরিভাষায়, রঘুনাথের এই মন্দির হল ‘পঞ্চরত্ন’। উঁচু পাদপীঠ, পাঁচ ধাপ সিঁড়ি অতিক্রম করে মন্দিরে উঠতে হয়। পাদপীঠখানিরও বেশ সুন্দর গড়ন। অনেকগুলি প্যানেলে ভাগ করা।

প্রশস্ত ‘প্রদক্ষিণ পথ’ আছে পাদপীঠের উপর, মন্দিরকে বেষ্টন করে। সামনে তিনটি দ্বারপথ। অতিক্রম করলে, একটি আয়তাকার অলিন্দ। গর্ভগৃহে প্রবেশের দ্বারপথ একটিই। দ্বারপথগুলি রচিত হয়েছে ‘খিলান রীতি’তে। সামনে দু’টি পূর্ণ-স্তম্ভ (পিলার) এবং দু’টি অর্ধ-স্তম্ভ (পিলাষ্টার)-এর সাহায্যে সামনের তিনটি দ্বারপথ রচিত হয়েছে।

অলিন্দের ভিতরের ছাদ তৈরি করা হয়েছে টানা অর্ধ-খিলান রীতিতে। গর্ভগৃহের ভিতরের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে চারদিকে চারটি খিলান নির্মাণ করে, তার মাথায় গম্বুজের সাহায্যে। বাংলায় মুসলমানি শাসন প্রবর্তন হওয়ার পর থেকে ইসলামীয় স্থাপত্যের ‘গম্বুজ-রীতি’টি বাংলায় জনপ্রিয় এবং ব্যবহৃত হতে শুরু করেছিল। গর্ভগৃহে পিছনের দেওয়ালে বেশ রাজকীয় গড়নের স্থায়ী বেদি। তাতে তিন দেবতার অধিষ্ঠান।

গর্ভগৃহ বা মন্দিরের মূল কাঠামোর মাথার ছাদ ‘চালা-রীতি’তে ঢালু, গড়ানো। তার উপর পাঁচটি রত্ন নির্মিত। উঁচু বেদি নির্মাণ করে কোণের রত্নগুলি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিটি রত্ন এক একটি শিখর মন্দিরের আকৃতিবিশিষ্ট। নীচের বাঢ় অংশটি ঋজু ভঙিমার লম্বা গড়নের। তাতে চার দিকেই চারটি লম্বাকৃতি সংকীর্ণ দ্বারপথ। ভিতরে শূন্য গর্ভগৃহ।

রত্নগুলির গণ্ডি অংশ (যেটি আসলে ছাউনি অংশ) দু’টি ভাবে নির্মিত হতে পারে— শিখর-দেউল কিংবা চালা রীতিতে। এই মন্দিরের পাঁচটি রত্ন শিখর-দেউল রীতির। ওড়িশার বিখ্যাত ‘পীঢ়-রীতি’তে নির্মিত হয়েছে রত্নগুলির উপরের অংশ। খাঁজকাটা ‘থাক’ ভাগ করা হয়েছে এই অংশে। এছাড়াও ‘পঞ্চরথ বিন্যাস’ দেখা যায় পাঁচটি রত্নেই। প্রতিটি রত্নের মাথায় বেঁকির উপর একটি করে আমলক, কলস এবং বিষ্ণুচক্র স্থাপিত।

এই এক মন্দির, যাতে টেরাকোটা, স্টাকো এবং পঙ্খ— তিন রীতির কাজের সমাবেশ দেখা যায়। মোটিফ হিসাবে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদির কাহিনি দৃশ্যায়িত হয়েছে ফলকগুলিতে। রামায়ণের রাম-রাবণের যুদ্ধ প্রায়শই মন্দির গাত্রে দেখতে পাওয়া যায়। এই মন্দিরেও সেই দৃশ্য সন্নিবদ্ধ হয়েছে। মহাভারত থেকে আছে দৌপদীর বস্ত্রহরণের বিরল দৃশ্যটি। কৃষ্ণলীলা বিষয়ক ফলকের প্রাধান্য দেখা যায় এই মন্দিরে। তার মধ্যে নৌকাবিলাস ফলকটি উল্লখযোগ্য। পৌরাণিক দেব-দেবীদেরও অনেক উপস্থিতি আছে দেওয়ালে।

ভগবান বিুষ্ণর মন্দির। সেকারণেই বোধ করি, বিুষ্ণর দশাবতারের মূর্তিগুলিকে বিশেষভাবে স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সপ্তমাতৃকা-র মূর্তিগুলি উৎকীর্ণ হয়েছে। সেকালের সমাজচিত্রও ফুটে আছে ফলকগুলিতে। সাহেবদের শিকারদৃশ্য কয়েকটি আছে। আছে বাইজি নাচের দৃশ্যও। এই সকল ফলকের স্থান হয়েছে পাদপীঠের ঠিক ওপরের অংশে। বিশিষ্ট ফলক আছ মন্দিরের উত্তর এবং দক্ষিণের দেওয়ালে। বাতায়নবর্তিনীর বদলে, দ্বারবর্তিনীর মূর্তি। অর্ধ উন্মুক্ত ভিনীশীয় রীতির দ্বারপ্রান্তে প্রতিক্ষারতা নারী। সচরাচর যা দেখা যায়, মূর্তিগুলি তেমন নয়। বিশেষত দক্ষিণের দেওয়ালের মূর্তি দু’টি। সেখানে মুক্তবক্ষ দু’টি প্রৌঢ়া নারী— সচরাচর যা দেখা যায় না।

মন্দির জীর্ণ হলেও দেবতা বিরাজিত আছেন মন্দিরে। নিত্য সেবাপূজাও হয় তাঁর। অনুষ্ঠিত হয় বছরের বড় উৎসবগুলিও। তবে সংস্কারের অভাবে জীর্ণতা গ্রাস করতে শুরু করেছে সুন্দর দেবালয়টিকে। মন্দির-মসজিদ চিরকালই কেবল ঐতিহ্যের বিষয় নয়, এগুলি আঞ্চলিক ইতিহাসের মূল্যবান উপাদানও। সেবাইত পরিবার কিংবা স্থানীয় পঞ্চায়েত কর্তাগণ ও সরকারি প্রশাসন এই প্রাচীন সৌধগুলির সংস্কার এবং সংরক্ষণে উদ্যোগী হলে এগুলি সুরক্ষিত হতে পারে।

সাক্ষাৎকার ও সহযোগিতা
সর্বশ্রী মাধবচন্দ্র সরকার, তমাল কলামুড়ি, অভিজিৎ মণ্ডল— আনন্দপুর।
পথনির্দেশ
মেদিনীপুর থেকে উত্তরমুখী পথে রানিগঞ্জ রোড ধরে গোদাপিয়াশাল। সেখান থেকে পূর্বমুখী রাস্তায় ৮ কিমি দূরত্বে আনন্দপুর। মেদিনীপুর থেকে অনেক গাড়ি আছে, যেগুলি আনন্দপুর হয়ে যাতায়াত করে। পুরোটাই সুন্দর ঝাঁ-চকচকে রাস্তা।
ছবি
লেখক