রামজি মন্দির, রামবাগ (থানা- মহিষাদল, মেদিনীপুর)

চিন্ময় দাশ
মেদিনীপুর জেলায় দুই রানি খ্যাতিময়ী। পশ্চিমে শিলদার রানি কিশোরমণি। ইতিহাসে তাঁকে ‘রাজা’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আর, পূর্বে, মহিষাদলের রানি জানকীদেবী। ৩৪ বছর দক্ষতার সঙ্গে বিশাল একটি রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন এই রানি।
জনার্দন উপাধ্যায় ছিলেন উত্তরপ্রদেশের সামবেদীয় ব্রাহ্মণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ বাংলায় এসে মহিষাদলে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়― গঙ্গার পশ্চিমে, বিশালতার দিক থেকে, বর্ধমানের পর মহিষাদল দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি। জনার্দনের পর রাজারাম, তাঁর পর শুকলাল রাজা হন। শুকলালের পর, ১৭৩৮ সালে আনন্দলাল রাজা হন। ১৭৭০ সালে অপুত্রক অবস্থায় আনন্দলালের মৃত্যুতে, পত্নী জানকীদেবী ক্ষমতা পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: শ্যামসুন্দর মন্দির, বালিপোতা (মেদিনীপুর কোতওয়ালি থানা)

কিশোরমণি সুশাসন ও প্রজাকল্যাণের পাশাপাশি ১২টি শিবালয়, কিশোর-কিশোরী মন্দির, রাধাকৃষ্ণ মন্দির ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জানকীদেবীও অনেকগুলি দেবালয়ের প্রতিষ্ঠাত্রী। মহিষাদলে গোপালজিউ মন্দির, নন্দীগ্রামে জানকীনাথ শিবমন্দির, রামবাগে রামজি মন্দির ইত্যাদি তার উদাহরণ।
রাজধানী মহিষাদলের অদূরেই রামবাগ গ্রাম। সেখানে উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সুরচিত বাগিচা। অনুমান করা হয়, রামচন্দ্র অধিষ্ঠিত বাগিচা থেকেই ‘রামবাগ’ নামের সৃষ্টি। যাই হোক, গর্ভগৃহে রামচন্দ্র, সীতাদেবী ও লক্ষ্মণের বিগ্রহ রেখে বিশাল আকারের মন্দির এটি। ইটের তৈরি দক্ষিণমুখী সৌধটি আট-চালা রীতিতে নির্মিত। সারাজেলায় যতগুলি আট-চালা মন্দির আছে, তার মধ্যে আড়ে-বহরে এটিই সবচেয়ে বড় মন্দির।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের গড় হরিপুরে শতায়ু পূর্ণ করা রামচন্দ্র মন্দির

মন্দিরের সামনের দেওয়ালে একটি অতি জীর্ণ প্রতিষ্ঠালিপি আছে। বহুকাল যাবৎ সেটি পাঠের অযোগ্য। তবে মহিষাদলের আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক হরপ্রসাদ সাহু পূর্বেই লিপিটির পাঠোদ্ধার করে রেখেছিলেন― ”শুভমস্তু সকাব্দা ১৭১০ সতরস দস/ দিগৃষি চন্দ্রসখ্যেত্তু সাকেভূ সুতবাসরে/ ইদ্ধংশে ঘটসামাক্ষ্যা বেদীন্তমাস্যেতিথেৌ তথা/ ভূমিপানন্দলালস্য পত্নী শ্রীজানকীমুদা/ দদৌ শ্রীরামচন্দ্রায় মন্দিরঞ্চেদমুত্তমং।” (বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত) লিপির বয়ান থেকে এটি জানা গেল, ১৭১০ শকাব্দে বা ইং ১৭৮৮ সালে, রাজা আনন্দলালের পত্নী শ্রীজানকী দেবী, শ্রীরামচন্দ্রের এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন: একদা রাজার হাতে গড়ে ওঠা মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার রঘুনাথ মন্দিরের চেহারা আজ বড়ই করুণ

উঁচু পাদপীঠ, তার উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথ। একবারে রাজকীয় বিশালতা সৌধটির। মূল মন্দিরের দৈর্ঘ্য সাডে় ৪১ ফুট, প্রস্থ সওয়া ৩৭ ফুট। মাথায় প্রায় ৬০ ফুট উঁচু এই মন্দির। সামনে খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ। সেগুলি পার হয়ে একটি টানা অলিন্দ। সেখান থেকে দ্বিতলে উঠবার সিঁড়ি আছে। মেদিনীপুর জেলার অন্য কোনও চালা-মন্দিরে দ্বিতলের জন্য সিঁড়ি দেখা যায় না।
একটি অলিন্দ বেষ্টন করে আছে দ্বিতলের গর্ভগৃহকেও। অলিন্দের চার দিকে চারটি প্রশস্ত গবাক্ষ রচিত। নীচের মূল গর্ভগৃহটি অতি প্রশস্ত। তাতে একটিই দ্বারপথ। মন্দিরের সবগুলি দ্বারপথই খিলান-রীতির। অলিন্দের দীর্ঘ সিলিং হয়েছে ‘টানা-খিলান’ রীতিতে। গর্ভগৃহের অতি উঁচু সিলিং ‘ভল্ট্’ রীতি প্রয়োগ করে রচিত।
আরও পড়ুন: বিগ্রহহীন, পরিত্যক্ত আর ভারী জীর্ণ কেশপুর বাদাড় গ্রামের লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির
মন্দিরসৌধের মতো, গর্ভগৃহটি প্রশস্ত। সেখানে সিংহাসনটিও যেমন বিশাল, তেমনই রাজকীয়। বিশেষত, দারুতক্ষণ কর্মটি চেয়ে দেখবার মতো। বৈশিষ্ট্য হেল সিংহাসনের পায়াগুলি। ‘বৃষকাষ্ঠ’-এর মতো মানবমূর্তি খোদিত হয়েছে চারটি পায়াতেই। জেলায় অন্তত আর কোথাও এমন নিদর্শন নেই।
গর্ভগৃহের লাগোয়া পূর্বদিকে ছোট একটি কক্ষ আছে। দ্বিতলের সিঁড়িটি নির্মিত হয়েছে তার ভিতর থেকেই। এত বিশাল মাপের মন্দির। কিন্তু উল্লেখ করবার মত কোনও অলংকরণ নেই মন্দিরে। একসময় কেন্দ্রীয় দ্বারপথের মাথার উপর বরাবর দু’টি ভিতর দু’টি মূর্তি রচিত ছিল, কেবলমাত্র মুখমণ্ডল। সম্ভবত রামচন্দ্র এবং সীতাদেবীর। সেদু’টি আর দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: প্রাচীনতমের বিচারে কাঁথি মহকুমায় তৃতীয় ও পটাশপুর থানায় সর্বপ্রাচীন কিশোররায় মন্দির
প্রাচীরঘেরা অঙ্গনের ভিতরে, মন্দিরমুখী রাস্তার দুই পাশে, পরস্পর মুখোমুখি ছোট মাপের দুটি শিবমন্দিরও আছে― পঞ্চানন্দ শিব এবং বাণেশ্বর শিব। একটির দু’টিই আট-চালা রীতির মন্দির। দু’টিই বর্গাকার― দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১৩ ফুট হিসাবে। দু’টিরই উচ্চতা ২৫ ফুট। তিনটি মন্দিরই অতি জীর্ণ। তিনটি মন্দিরই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে অবলুপ্তির পথে। দেখবার কেউ নাই। মন্দিরের জরাজীর্ণ ইটের কাঠামো বাঁচাবার জন্য, বিচলিত হওয়ার মতো মানুষ কম পড়ে যাচ্ছে দিন-দিন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শ্রীমতী দীপালি বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষিকা, শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন। শ্রীহরপ্রসাদ সাহু, কবি ও সম্পাদক। শ্রীমুক্তি চক্রবর্তী, পুরোহিত― মহিষাদল।
পথ-নির্দেশ
যেকোনও দিক থেকে, তমলুক হয়ে হলদিয়া যাওয়ার পথে মহিষাদল। সেখান থেকে সামান্য দূরে রামবাগ গ্রাম। নিয়মিত ছোটগাড়ির যাতায়াত আছে। হলদিয়াগামী লোকাল ট্রেনেও মহিষাদল পৌঁছনো যাবে।
ছবি লেখক