একুশের ছাব্বিশ, নানা মনের নানান ভাবনা

মঞ্জিস রায়
এক অস্থির সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে আমাদের ছাব্বিশ, আমাদের প্রজাতন্ত্র। আমাদের প্রজাতন্ত্র কখনও ভুখা পেটে হাঁটে, কখনও রাজধানীর শীত উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। জাতীয় পতাকা ওড়ে অন্তরে ও বাইরে। আমরা চাই গণতন্ত্রের আকাশ আরও উন্মুক্ত হোক। গণতন্ত্রের খোলা হাওয়া আমাদের পথ দেখাক। সংবিধানকে যেন আমরা সম্মান করতে পারি। এই অতিমারি এবং আর্থ-সামাজিক অনিশ্চয়তার টালমাটাল সময়ে ২০২১-এর প্রজাতন্ত্র দিবস হয়তো ঘন কুয়াশা পেরিয়ে বা রোদের হাত ধরে এলো। এমন আশা তো করতে ইচ্ছেই করে। নানান মানুষের ভাবনায় নানাভাবে এবারের প্রজাতন্ত্র দিবস কী বার্তা নিয়ে এলো?
প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমর মিত্র-র ভাবনায় একুশের প্রজাতন্ত্র দিবস কীভাবে এসেছে, এ বিষয়ে জানার ইচ্ছে প্রকাশ করাতে উনি ওনার স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতার ছোঁয়ায় বললেন, ‘‘প্রজাতন্ত্র দিবসের ওপর মহামারি বা অতিমারি সেভাবে প্রভাব ফেলেনি। আর মহামারি তো এখন অনেকটাই চলে গেছে। তবে এবারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কৃষকদের র্যালি। এই ট্র্যাক্টর র্যালি সত্যিই অন্যরকম, যেরকমটা আমাদের দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। আমাদের ১৯৫০ সালে অর্জিত প্রজাতন্ত্রের জন্য আমরা গর্বিত। তবে এটাও সত্যি যে প্রজাতন্ত্র তেমনভাবে এখনও বিকশিত হয়নি। আমরা এখনও উন্নয়নশীল দেশ। আমি চাই দেশে আর্থিক স্বাধীনতা আসুক, যার জন্য কৃষকেরা নানান প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছেন। চাই, সবাই যাতে নির্ভয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারে। সরকারও সবার কথা ভেবে কাজ করুক।”
একুশের প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা ভেবে বিশিষ্ট কবি যশোধরা রায়চৌধুরি বললেন, ‘‘গোটা বিশ্বের যে অস্থির অবস্থা, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেদের সংবিধানকে সম্মান দেওয়ার কথা আবার মনে করিয়ে দেয় এই দিনটি। আমেরিকা দেখিয়ে দিল একটি অগ্রগণ্য দেশেও সংবিধান লঙ্ঘিত হতে পারে। ক্যাপিটলে ঢুকে যেতে পারে দেশেরই লোক, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী না। তারা আবার নতুন করে মনে করাল গণতন্ত্রকে বুক দিয়ে আগলে রক্ষা করতে হয়। প্রজাতন্ত্র দিবস তো এই রক্ষা করার শপথ নেবার দিন।”
আরও পড়ুন: সংবিধানের জন্মকথা: প্রজাতন্ত্র দিবসের গল্প

এই মহামারি বা অতিমারির দিনগুলিতে কখনও পরিস্থিতির শিকার হয়েছে গণতন্ত্র, কখনও উঠে এসেছে নতুন স্বর, নতুন বার্তা। সেই ভালো এবং মন্দের কথা মনে করেই পেশায় সাইকোলজিস্ট শুভ্রা ব্যানার্জি পাল বললেন, ‘‘এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে যে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা সাংবিধানিক অধিকার কতটা রক্ষা করতে পারছি। অতিমারির সময়ে শরীর মনের পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষকে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কেউ কেউ সেটা কাটিয়ে উঠতে পারছে। আমরা এসময় হিংসা দেখেছি, আবার অহিংসাও দেখেছি, অসহযোগিতা পেয়েছি আবার সহযোগিতাও পেয়েছি। আমরা দেখেছি হাজার হাজার মানুষ কাজ ছাড়া হয়েছেন, তাদের শরীর, মনের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। তারপর এই কৃষি বিলের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ এগিয়ে এসেছেন। তাঁদেরও তো একটা চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমার মনে হয় এমন সময় আসুক, যখন আমরা সকলে সকলের জন্য বাঁচব। গণতন্ত্র তো আসলে জনসাধারণেরই তন্ত্র।”
স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কাছে এবারের ছাব্বিশে জানুয়ারি ঠিক কীভাবে এলো, সে-বিষয়ে কিছু কথা বললেন সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা সুজাতা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘এই বছর মহামারির ভয়াল প্রকোপে দেশ। প্রায় এক বছর হতে চলল স্কুল বন্ধ। এই বছর সরকারের নির্দেশ অনুসারে স্কুলে প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হবে, কিন্তু যাদের জন্য আয়োজন তারাই অনুপস্থিত থাকবে। তাই একটা অস্বাভবিক ব্যাপার। এই দিনটি পালনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা এই দিনটির গুরুত্ব, দেশের ইতিহাস, এই দিনটি আসার পেছনে কত অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ, সমাজে এবং দেশগঠনে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত হয়। এই ক্ষেত্রে সে-সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হল। আর আমার কাছে এবারের প্রজাতন্ত্র দিবস কিছুটা অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তাই আমাদের এখন ইতিহাস চর্চা করা এবং ছাত্রছাত্রীদের তা জানানো কর্তব্য বলে মনে করি।”