সুরঞ্জন প্রামাণিক
যোনিই পাপের উৎস— জন্ম জরা ব্যাধি মৃত্যু তার পরিণাম
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে তেমন কোনও কথা হয়নি। সম্ভবত আমারই মতো সোমা তখনও সভার মধ্যে ছিল। এবং সেটা বোঝাও গেল বাড়ি ফিরে চায়ের টেবিলে— সত্যব্রতর কথা তার ভালো লেগেছে, তার কাছে ‘ঈশ্বর ইক্যুয়াল টু দ্য গ্রেট ক্যজ!’ কথাটা সোমার অনুবাদ। ভাবনাটা সুন্দর। সত্যব্রত সম্বন্ধে কথা বলার সময় সোমা যেন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। তার পর সে আমার প্রশংসা করে বলল, ‘আজও কিন্তু আমার মনে হল, ওরা তোর পঞ্চশিষ্য!’ আমি কোনও কথা বললাম না। যদিও আমার মনে একটা কথা তৈরি হয়েছিল। সে কথাটা কিন্তু এখনও আমি বলব না। যাই হোক, কথাটা নিয়ে সোমাও আর কিছু বলল না। চা শেষ করে তখনও একটু বেলা ছিল, আমি বললাম, ‘চল আমার সেই হেড স্যারের বাড়ি ঘুরে আসি!’ সে রাজি হল। যেতে যেতে বললাম, ‘এই সেরিব্রাল এক্সারসাইজ, আমি ভাবছি, কোন সত্যে পৌঁছে দেবে আমাকে? আদৌ কি কোথাও পৌঁছাব!’ সোমা থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।’
‘মানে?’
‘আমার মনে হচ্ছে, তুই লক্ষ্যটা ভুলেছিস।’
আশ্চর্য! আমার লক্ষ্য ছিল! ভুলে গেছি? জিজ্ঞেস করলাম। সোমা বলল, ‘বোধি!’
‘আমি কি এ রকম বলেছি কখনও?’
‘না। বোধি মানে বিশেষ জ্ঞান, সিদ্ধার্থের ক্ষেত্রে তা ছিল দুঃখ নিবৃত্তির জ্ঞান। জগৎ আজও দুঃখময়। এ-সব কথা আমাদের আলোচনায় এসেছে! একটা সিনেমার অনুষঙ্গে, মনে আছে, আমরা একমত হয়েছিলাম— যৌনতা বা যৌনবিযুক্ততা দু’-ই মানবজীবনে ট্র্যাজেডি ডেকে আনে, আমার মনে হয়েছিল, যৌনতা নিবৃত্তির জ্ঞানই তোর লক্ষ্য!’
পথের দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত। প্রায় উত্তর দিগন্ত ছোঁয়া বিস্তার। একটা বাবলা গাছের পাশে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে বেলাশেষের রং সোমাকে রাঙিয়েছে। পথ বরাবর যত দূর দৃষ্টি যায়, কোথাও কেউ নেই, আমার যতটুক দ্বিধা ছিল তা কাটিয়ে আমি সোমাকে জড়িয়ে ধরলাম। এই আবেগকে তুমি কী বলবে? এই আবেগ থেকেই কিন্তু আমরা আর স্যারের বাড়ি গেলাম না। সেখানে দাঁড়িয়েই আমাদের আরও কথা হল। ‘দুঃখ নিবৃত্তি’র অনুকরণে কি আমরা ‘যৌনতা নিবৃত্তি’ কথাটা বলছি? আমাদের কথা শুরু হয়েছিল এই প্রশ্ন থেকে। সোমা আমাকে যুক্তি দিয়ে দেখাল যে, এটা অনুকরণ নয়, গৌতম বুদ্ধের বোধি অনেক বড় ব্যাপার, মানে দুঃখের পরিসর অনেক ছড়ানো, মানে অনেক রকমের দুঃখ; তার মধ্যে যোনিও আছে, যে কারণে পুরুষের আধ্যাত্মিক পথে রমণী বাধাস্বরূপ, এ কথা তিনি অস্বীকার করেননি, এমনকী রমণীর পক্ষে বোধিসত্ত্ব হওয়া সম্ভব নয়, এমন কথাও বলা হয়েছে অর্থাৎ যোনি বা যৌনতা যে দুঃখের কারণ, এটা তো আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছি, অতএব, ‘যৌনতা নিবৃত্তি’ মানে ছোট মাপের ‘দুঃখ নিবৃত্তি’! এটা আমরা ভাবতেই পারি। আর যেহেতু ‘দুঃখ নিবৃত্তির জ্ঞান’ মানে বোধি সেহেতু ‘যৌনতা থেকে দুঃখ নিবৃত্তির জ্ঞান’কেও আমরা বোধি বলতে পারি। সোমার যুক্তি গ্রহণ করে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার লক্ষ্য বোধি! আর ভুলব না!’
আরও পড়ুন: অমরত্বের অন্বেষণ

‘যোনি-কেন্দ্রিক দুঃখগুলো তুই ভাব! সিদ্ধার্থ জরা-ব্যাধি-মৃত্যু দেখে মানুষের দুঃখ বুঝেছিলেন— জন্মই দুঃখের কারণ, এমন একটা সরল সিদ্ধান্ত আমরা বানিয়ে নিয়েছি, সত্যও বটে!’
‘তা হলে— জন্মের সঙ্গে তো যোনির সম্পর্ক রয়েছে।’
‘হ্যাঁ তা আছে— জন্মদ্বার!’
‘তা হলে কি যোনিই পাপের উৎস নয়?’
‘না। মন। ভুলে গেলি? মনেই পাপের জন্ম। তার পর কী ভেবে বলল, ‘তবে এ রকম ধারণা চালু আছে— রেপ, যোনি রক্তাক্ত করার যেসব ঘটনা সাম্প্ৰতিকে ঘটেছে, তা বোধহয় তারই প্রকাশ— কোন্ অবচেতন থেকে, কে জানে!’
‘এই ‘সেমিনার অন রেপ’-এর কথা বলছিল সুব্রতদা, ব্যাপারটা কী?’
‘রেপের ঘটনায় মাইনর এজ জড়িয়ে পড়ছে যে!— তুই কি এই খবরটা জানিস সাত নাবালক সেভেনে পড়া এক মেয়েকে…’ কথা আটকে গেল যন্ত্রণায়। সম্ভবত সোমা বুঝতে পারেনি, বলল, ‘না।’
আমি সামলে নিয়ে বললাম, ‘বাড়ি ফিরে আগে খবরটা পড়াই! তার পর বলব।’
খবরটা পড়ার পর সোমা কোনও কথা বলেনি। আমিও চাইনি তাকে কথা বলাতে। অনেকক্ষণ আমরা কথা বলিনি। কেবল খাবার টেবিলে সে মাকে বলল, ‘খিদে নেই, ভাত অল্প দেবেন! শোয়ার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না, ঠিক আছি।’
‘সেমিনারের ব্যাপারটা বলব?’
‘হু, বল!’
খবরটা পড়ার পর আমার যা হয়েছিল, বললাম। এবং তখনও আমি যে সেই যন্ত্রণাই অনুভব করছি, তা জানিয়ে তার পরের ঘটনাগুলো, থানা-পুলিশ, সুব্রত… বলতে বলতে আমি বুঝতে পারি সোমার হাত যেন আমার যোনির যন্ত্রণা মুছে দিতে চাইছে। তার পর কেন জানি না, আমাকে জড়িয়ে ধরে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
তোমার চোখেও কি জল জমল, বন্ধু!
ক্রমশ…
উপন্যাসের বাকি অংশগুলি পড়তে ক্লিক করুন:
সম্বুদ্ধজাতিকা (১ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (২য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৩য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৪র্থ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৫ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (ষষ্ঠ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৭ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৮ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৯ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (১০ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (একাদশ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (অংশ ১২)
সম্বুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৩)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৪)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৫)
ছবি ইন্টারনেট