সুরঞ্জন প্রামাণিক
ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে নাকমুখ কুঁচকে মাথাটা মৃদু ঝাকালাম। সুজন মিত্র ভীষণ বদলে গেলেন। গম্ভীরভাবে জানতে চাইলেন, ‘জীবন বলতে তুই কী বুঝিস? আই মিন, সংজ্ঞা কী, জানিস?’
নিশ্চয় আমি জানতাম বা একটা সংজ্ঞা তৈরি করার মতো জ্ঞানগম্যি আমার আছে তবু কেন জানি না একটু কুঁকড়ে গিয়ে বললাম, ‘না!’ তিনি স্বাভাবিক স্বরে বললেন, ‘গুড। জীবনের সংজ্ঞা— জীবনবিজ্ঞান অনুসারে বলা যায়, অসংখ্য রাসায়নিক পদার্থের ঘনীভূত বন্ধন বা বন্ড আর তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ— এই জীবন। আর সমাজবিজ্ঞান অনেক রকমের সংজ্ঞা দিতে পারে, যেমন, লাইফ ইজ এ চ্যালেঞ্জ— এ রকম আরও কথা নিশ্চয়ই শুনেছিস, দেখেও থাকতে পারিস, দোকানে ছাপানো চার্ট ঝোলানো থাকে, পনেরো-কুড়ি রকমের! দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘বল একটা!’
‘লাইফ ইজ এ ডিউটি! নিশ্চয়ই মনে আছে, সংজ্ঞার পরেই অ্যাকশনের কথা বলা ছিল, পারফর্ম ইট?’ আমার সায় দেখে বললেন, ‘সো, জীবনের সংজ্ঞাই ঠিক করে দেয়, অ্যাকশন! আমরা কী করব, কী করব না।’
আরও পড়ুন: বাংলায় বিবিধরূপে মনসা পার্বণ ও রান্নাপুজো
আমি বললাম, ‘কিন্তু স্যার, অ্যাকশনের থেকে তথ্য নিয়েই তো সংজ্ঞা তৈরি হয়।’
‘সে যাই হোক, এ সব সংজ্ঞায় অন্ধকারের কথা বলা নেই!’
আমার তখন মনে পড়ল, জীবন এক দুঃখময় অস্তিত্ব! অজ্ঞতাই দুঃখের কারণ, আর অন্ধকারকে অজ্ঞতার প্রতীক বলেই তো জানি… বললাম, ‘আছে। অন্তত একটি সংজ্ঞায় আছে। জীবন দুঃখময়!’
সুজন মিত্র বলে উঠলেন, ‘অভারকাম ইট! মানে কী? আলো জ্বালো! কিন্তু দুঃখ মানে কী? এক কথায় আমাদের ইন্দ্রিয়র বিষণ্ণ হওয়া, যেমন, এই মুহূর্তে আমার মধ্যে এক দুঃখবোধ জন্মেছে, কেন জানো?” আমি মাথা নাড়লাম। তিনি বললেন, ‘তোমার সেই ফুটন্ত ভাবটা এখন আর নেই, দীপ্তিমুখ ম্লান হয়েছে। তুমি বলো তো কোন অজ্ঞতা বশে আমার এই দুঃখবোধ?”
একটা ভাবনা আসছিল, বাধা পেল, ‘তুইও কি আর আগের মতো দেখছিস আমাকে?’ ওঁর মুখের দিকে বিষণ্ণ তাকিয়ে থেকে না-ভঙ্গিতেই মাথা নাড়তে হল মৃদু।
‘তার মানে আমার মধ্যেও কিছু একটার অভাব দেখছিস তুই!’
তখনই ভাবনাটা ফিরে এলো, তার মধ্যে ঢুকে পড়ল ‘অভাব’… মানে একইসঙ্গে আমরা অভাব অনুভব করছি এবং দু’জনের মধ্যেই অভাব তৈরি হয়েছে… মাথার মধ্যে কী সব কাটাকুটি হওয়ার পর আমি ওই শব্দটাই উচ্চারণ করলাম! সুজন মিত্র সবিস্ময়ে বললেন, ‘মানে?’
‘মানুষ মানে এক অভাব তাড়িত এন্টিটি!’
যেন তিনি চমৎকৃত হলেন, ভীষণ উৎসাহে বলে। ‘এর থেকে জীবনের সংজ্ঞাও তো তৈরি করা যায়!’ তাঁকে বেশ উজ্জ্বল দেখালো। আমি সায় দিলে তিনি বললেন, ‘তুই কী আলোচনা করতে এসেছিস, জানি না, তবে সন্দেহ নেই, আমরা এক মৌলিক বিষয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছি, অভাব— সমস্ত জীবের ক্ষেত্রে এ যেমন সাধারণ সত্য, তেমন মানুষের ক্ষেত্রে এ এক বিশেষ সত্য। আর একটু কথা বোধ হয় আমরা বলতে পারি!’ যেন অনুমতি চাইলেন। আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘বলো!’
‘জীবন মানে আমরা যা জেনেছি, তার বাইরে, জীবন মানে, খুব সহজ কথা, বেঁচে থাকা! এটা আমরা বলতে পারি? (আমার সায় দেখে) ফাইন! বেঁচে থাকা মানে কী? (আমাকে চুপ দেখে) মানে হল আহার, নিদ্রা, প্রজনন, ভয়— এসবের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে রুখে দেওয়ার নিত্য প্রচেষ্টা! রাইট?’
আমার তখন মিচেল হেসম্যান মনে পড়ছিল, একটু অন্যমনস্কভাবে ‘হু!’ বললাম।
‘আবার, এই চার জীববৈশিষ্ট্যের মধ্যেই-কিন্তু মৃত্যু রয়েছে।’
‘কীরকম?’
‘যেমন আহার্য না পেলে মৃত্যু হতে পারে, চা-বাগানে অনাহারে মৃত্যুর কথা নিশ্চয় তুই জানিস!’
‘তার মানে বেঁচে থাকাতেই যত অভাব!’
‘বাঃ! ভালো বললি তো! ইয়েস! তোর কি ভিন্ন মত আছে?’
‘নো। আই এগ্রি!’
আরও পড়ুন: ‘নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি’: বঙ্গে বিশ্বকর্মা

তিনি একটু ভেবে বললেন, ‘অর্থাৎ ওই চার বৈশিষ্ট্যই আমাদের সমস্ত অভাবের উৎস!’ আমি বললাম, ‘যুক্তি তো তা-ই বলছে।’ তিনি যেন নতুন কথা খুঁজে পেয়ে বললেন, ‘তা হলে ভেবে দেখ, এই অভাবই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা!’ আমার মধ্যে কথা জন্মাল, ‘তা হলে এই প্রেরণাই আমাদের দুঃখের কারণ বলতে হবে!’
‘হিংসার উৎসেও কি এই অভাব নয়?’
‘একদম! এই প্রেরণা থেকেই আমরা পাপ করি!’
‘অবশ্যই।’
তা হলে— আমার ভাবনা এলো, বেঁচে থাকা মানেই দুঃখ পাপ হিংসায় জড়ানো! সে কথা বলতেই সুজন মিত্র যেন ভাবনায় পড়লেন। যেন আমার কথার প্রতিধ্বনি উঠে এলো তাঁর কথায়, আমি বললাম, ‘তা হলে স্যার, অন্ধকার কোথায়?’ মনে হল প্রশ্নটা স্যারের মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে, একই সঙ্গে যেন উত্তর খুঁজছেন, তাঁর দৃষ্টি দেখে আমার তেমনই মনে হল, দৃষ্টি দরজার দিকে… দরজায় অণিমাকে দেখে সুজন মিত্র বললেন, ‘যা! ডাক পড়েছে যা, রান্না করে খাবি, খাওয়াবি!’ অণিমা ডাকলেন, ‘এসো!’ আমি মোবাইলটা যেমন ছিল তেমন ভাবেই নিয়ে বের হলাম।
আমরা মেয়েরা এক-একটা বই— বই জানে না তার কী পাঠ
রান্নাঘরের মেঝেতে আনাজপাতি ছড়ানো। বোঝা যাচ্ছে ব্যাগ থেকে ঢেলে রাখা হয়েছে। সেগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে অণিমা বললেন, ‘দ্যাখো কী রাঁধবে!’ আগেই কচি নিমপাতা আর বেগুন নজরে পড়েছিল, বললাম, ‘নিমবেগুন…’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা। আমি তা হলে লাউডাল করি। আর মাছটা তোমার স্যার করবেন— মাছে আপত্তি নেই তো?’
আমি বললাম, ‘না।’
‘তুমি-কিন্তু লাউটা কেটে দেবে! কী কথা হল আজ?’
আমি ততক্ষণে অণিমার সামনে একটা উঁচু পিঁড়িতে বসে পড়েছি। বললাম, ‘বেঁচে থাকা নিয়ে বেঁচে থাকা মানে দুঃখ-পাপে জড়নো এই সিদ্ধান্তে আপাতত পৌঁছেছি আমরা।’ এই স্বভাব তোমার স্যারের আনন্দ কি নেই? আছে, জানেনও কিন্তু কথা বলার সময় মনে রাখেন না। আচ্ছা, তুমিই বলো, আনন্দ যদি না-ই থাকবে— কান পাতো! শুনতে পাচ্ছ?”
‘পাখির ডাক?’
‘কী মিষ্টি ডাক! বলো! একে তুমি আনন্দ বলবে না! পাখিটা কি দুঃখে ডাকছে?’
‘না, আনন্দ-ই তো!’
‘চার দিকে তাকিয়ে দেখ তো— কোথায় দুঃখ!’ তার পর তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ‘এসো!’ আমরা বাইরে এলাম। এটা বাড়ির পিছন দিক। ফসলের ক্ষেত। ধান, গোলাপ-গাঁদা, পটলের মাচা… এক রঙিন পট যেন, ‘কোথাও কি দুঃখের সুর বাজছে?’ পেছন থেকে বললেন তিনি, ‘শুনতে পাচ্ছ?’ আমি মাথা নাড়লাম। আমার মনে প্রশ্ন এলো, অণিমা কি সুজন মিত্রকে ডিসকার্ড করতে চাইছেন? নাকি তাঁর প্রতি আমার যে টান তাকে আলগা করতে চাইছেন? পরক্ষণেই ভাবলাম, এমন ভাবছি কেন? তখনই আমার কাঁধে আলত ছোঁয়া দিয়ে বললেন, ‘কী ভাবছ? স্যারের বদনাম করছি! একদম না। আসলে তোমার স্যার দুঃখবিলাসী— পুরুষেরা এঁকে খুব তোল্লাই দেয়, মেয়েরা খুব একটা আসে না। এই প্রথম তুমি দ্বিতীয় বার এলে, কথা বলার সুযোগ হল― তোমাকেই বলছি, এটা, মানে এই দুঃখবিলাস, ঠিক না!’
‘স্যারকে কখনও বলেননি?’
‘তুমি আমার মেয়ের বয়সি, কী বলব, আমি কেবলমাত্র ওর দেহসঙ্গী হয়েই আছি মননের সঙ্গী হতে পারিনি। হয়তো এ কারণে ওঁর দুঃখ— শরীরমন্থনে তো আর মননের মধু উৎপন্ন হয় না!’
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম, ‘আপনার দুঃখবোধ নেই?’
‘একেবারে যে নেই, তা বলা যাবে না, ছেলে-মেয়েরা কাছে নেই, আমার বাবা খুব অসুস্থ— খুব একটা যাওয়া হয় না— এসব থেকে মনখারাপ হয়, তাকে তুমি দুঃখই বলতে পারো। এ ছাড়া আমি সুখী।’
‘তা হলে মননের দিক থেকে আপনার তো দুঃখ থাকার কথা!’
‘নিজের সঙ্গে কথা বলি তো! মননের সুখ অনেকটা আত্মরতির মতো, ভাবতে পারো! এই যে পাখির ডাক শুনে পাখির আনন্দ বুঝলাম আবার নিজেও আনন্দ পেলাম।’
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ার সমসাময়িক সাহিত্যপত্র

আমরা রান্না ঘরে ফিরে এলাম। (মোবাইল অফ ছিল বলে এখনকার কথা সব স্মৃতি-নির্ভর, তুমি কিন্তু মনে রাখবে, কল্পনাও করতে পারো, রান্নার কাজের সঙ্গে কথা চলছে।) রান্নাঘরের আলাপচারিতায় জানা গেল, সুজন মিত্র গৌতম বুদ্ধ প্রভাবিত, অণিমার কথায় আমার মনে হওয়াটা মিলে গেলেও কেমন খটকা লাগল। মানুষের অবস্থান শাশ্বত অন্ধকারে, তাঁর এই তত্ত্বটা বুদ্ধভাবনার সঙ্গে মেলানো যায় কিন্তু মানুষ ব্যর্থ আলোর অভিযাত্রী… নাহ্, মেলে না। তা হলে গৌতম বুদ্ধকেই ব্যর্থ বলতে হয়!
‘গার্হস্থ্য মানুষ হিসাবে তোমার স্যার কিন্তু চমৎকার! তবু কী এক অতৃপ্তি যে বয়ে বেড়ান্! বোঝা যায়।’
আমি ভাবলাম, তার মানে তৃষ্ণা বুদ্ধ-ভাবনায় দুঃখের কারণ তৃষ্ণা। জ্ঞানতৃষ্ণা?
‘আমার মনে হয় বইয়ের মধ্যে সুজন কিছু খোঁজেন!’
আমি বললাম, ‘মনে হওয়াটা ঠিক, আমাকে এ রকমই বলেছেন!’
‘কীসের খোঁজ?’
‘লক্ষ্য খোঁজেন!’
‘এটা ঠিক। ওঁর জীবনে কোনও লক্ষ্য আছে বলে মনে হয়নি।’ বলে অণিমা যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন, বললেন, ‘তুমি বিয়ে করবে না, সিদ্ধান্ত নিয়েছ তা হলে যৌনতা নিয়ে ভাবছ কেন, লিভ টুগেদার? তুমি তো মানবিক যৌনতা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলে! তত্ত্ব না হয় বুঝলে, ওটা তুমি অনুভব করবে কেমন করে?’
‘যৌনতা— এই ধারণাটা মূলত পুরুষের—’
‘সে আমি শুনেছি— তোমার প্রশস্তি করেছেন সুজন কিন্তু পুরুষ যে মানবিক, তা তো কেবল বুদ্ধি দিয়ে বোঝার নয়, এক্ষেত্রে শরীরী অনুভবই আসল! আমার মনে হয় তোমার স্যার আমার শরীরেও কিছু খোঁজেন।’ কথাটা একদম নতুন বলে মনে হল। এক জন পুরুষ নারীদেহে কিছু খুঁজছে, বইয়ের মধ্যেও তার খোঁজ রয়েছে এটা যদি সাধারণ তত্ত্ব হিসাবে ধরা হয় তার মানে নারীদেহ বইয়ের মতো কিছু? প্রশ্ন না রেখে কথাটা ভাবতেই মনে হল, অণিমা আমাকে কোনও এক আবিষ্কারের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন! আমি বললাম, তার মানে আমরা মেয়েরা— এক-একটা বই!’
আমার মুখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অণিমা বললেন, ‘খুব ভালো বলেছ!’ তার পরক্ষণেই তাঁর মুখখানা কেমন ম্লান হয়ে গেল, ‘কিন্তু বই কি জানে কী তার পাঠ?’ যেন মুহূর্তে মিলিয়ে গেল আবিষ্কার সম্ভাবনা। তার পর-পরই কী ভেবে তিনি বললেন, ‘তুমি আজ থেকে যেও!’
ক্রমশ…
উপন্যাসের বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন:
সম্বুদ্ধজাতিকা (১ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (২য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৩য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৪র্থ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৫ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (ষষ্ঠ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৭ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৮ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৯ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (১০ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (একাদশ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (অংশ ১২)
সম্বুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৩)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৪)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৫)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৬)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৭)
সমুদ্ধজাতিকা (অংশ ১৮)
ছবি ইন্টারনেট