সুরঞ্জন প্রামাণিক
প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণ মিশে আছে আন্তর্জালিক নিয়মে
সেদিন সভায় বাবা উঠে দাঁড়াতে পারেননি। কেউ তাঁর পাঞ্জাবির হাতা টেনে ধরে তাঁকে বসিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সোমা ছাড়া সকলে চলে যাওয়ার পরও তিনি সেখানে যাকে বলে স্থাণুবৎ বসেছিলেন। তাঁকে কেমন হতভম্ব দেখাচ্ছিল। কখনও মনে হচ্ছিল ক্রুদ্ধ। মা একবার উঠতে বললে বিরক্তির ঢঙে হাত তুলে নিষেধ করলেন। এক একবার তাঁকে অচেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু মুখের ভঙ্গিটা চেনা, এ রকম আগেও দেখেছি, মনে পড়ল। এটা অন্য গল্প। বলতে হবে।
আমাদের বাড়িটা বেণেবাড়ি বলে পরিচিত, বলেছি। আমরা কিন্তু বণিক ছিলাম না। আবার এখন বণিকও বটে। গল্পটা এখানে। আমার বাবার বাপঠাকুরদারা ছিলেন চাষা। ভালো কথায় কৃষিজীবী। আমার ঠাকুরদা ভেন্ন হয়ে জন্মভিটে ছাড়লেন কিন্তু বসত গাড়লেন সেই চাষাপাড়ায় তবে চাষের জমি আর না কিনে বাড়িতেই খোলেন মুদিদোকান। সেই থেকে চাষাপাড়ায় আমাদের বাড়িটা ক্রমে বেণেবাড়ি নাম পায়। তা বলে ঠাকুরদা চাষকাজ একেবারেই ছেড়ে ছিলেন তা-কিন্তু নয়, তিনি ভাগচাষি হয়ে গেলেন। ভাগচাষ আর দোকানদারি— কেমন যেন দোআঁশলা ব্যাপার। এ-রকম কথা ঠাকুরদার মুখে কথা প্রসঙ্গে আমরা শুনেছি। আমার বাবাকে নাকি তিনি খাঁটি বেণে হওয়ার কথা বলতেন। লেখাপড়া শিখলেই নাকি খাঁটি বেণে হওয়া যায়— আমার বাবা অবশ্য তখনকার স্কুল ফাইনাল, থার্ড ডিভিশন কিন্তু তাতেই ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছেন মন্দ না। শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসার কী সম্পর্ক, তা অবশ্য আমি জানি না। আমাদের এখন ভাগচাষও নেই। তবু বিশুদ্ধতার প্রশ্নে, ক্রোধ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাবা নিজেকে এখনও চাষার ছেলে বলে ঘোষণা করেন। সেই জন্মদিনের ঘটনায় তিনি হয়তো সেরকমই কিছু বলতে চেয়েছিলেন। বলতে দেওয়া হয়নি। সেই মুহূর্তের চেপে রাখা ক্রোধ তাঁর মুখখানাকে যেভাবে ভেঙেচুরে তৈরি করেছিল, তা অভূতপূর্ব ছিল না, বলেছি— এবার মুখের সেই চেনা ভঙ্গিটা, তখন কেন তৈরি হয়েছিল, গল্পটা বললে খানিকটা বোঝা যাবে।
আরও পড়ুন: সম্বুদ্ধজাতিকা (১ম অংশ)

তখন, খবরের কাগজে, টিভি নিউজে চাষির আত্মহত্যা, তার পরিসংখ্যান ইত্যাদি নিয়ে কথা হত। এসব খবরে বাবাকে বিমর্ষ দেখাত খুব। এক বার কী সব দাবি নিয়ে কৃষকদের পদযাত্রা… খবর দেখে বাবা বলে উঠলেন, ‘লং মার্চ!’ তাঁর চোখমুখ অমন উজ্জ্বল হতে আগে আর দেখিনি। তিনি মাকে বললেন, ‘বুঝলে বেনেবউ, এবার কিছু একটা হবে! চাষিরা ক্ষেপেছে! লং মার্চ— চিনে ঘটেছিল…’
কিন্তু এখানে কিছুই হয়নি বরং খালি-পা চাষিদের কারও কারও রক্তাক্ত পা দেখে বাবার মনে ক্রোধ জন্মেছিল আর তিনি নিজের পায়ে হাত বুলাতেন, যেন তাঁরই পা বেদনায় জর্জরিত। রাগ ও যন্ত্রণার অনুভবে বাবার মুখের পরিবর্তন তখন প্রায়ই দেখা যেত…
সেদিনও তিনি পায়ে হাত বুলাচ্ছিলেন। ওই দিন বাবার মাইল্ড ব্রেনস্ট্রোক হয়, ডাক্তারের কাছ থেকে এটা আমরা পরে জানতে পারি। বুঝতেই পারছেন, এটা একটা সমস্যা।
আর-একটা সমস্যা— কীভাবে বলব— নিজের ধারণা মতো বুঝে নেবেন— সেদিন সোমা আর আমি আরও কয়েক বারের মতো এক বিছানায় শুয়েছিলাম… বাবার জন্য আমার মন খারাপের কথা বলতেই সোমা যেন আমাকে সমবেদনা জানাতে আমার মুখে হাত বুলালো। এ রকমটা আগে ঘটেনি। এই আদর পেয়ে আমি বললাম, ‘আমাদের এই ইন্টেলেক্টচুয়াল লড়াইটা বাবা ঠিক নিতে পারলেন না!’ সোমা বলল, ‘আমরা কিন্তু জিতেছি!’ আমি সায় দিলে সে বলল, ‘তা হলে সেলিব্রেট করা যাক!’
‘কীভাবে?’
‘তুই আমাকে একটা হামি দে!’
ওর গালে একটা চুমু দিতেই ও আমাকে তীব্র আশ্লেষে জড়িয়ে ধরল…
এক্ষেত্রে সমস্যাটা হল, আমার ভালো লাগা, আমি বাধা দিতে পারিনি— যেন এক পুরুষ আমার শরীর নিয়ে খেলছে… বস্তুত সোমাকে প্রবল এক পুরুষ বলে মনে হয়েছে যদিও পুরুষ সম্পর্কে ঘিনঘিনে পর্ণো-এক্সপেরিয়েন্স ছাড়া আমার আর-কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না।
সমস্যাটা কি বুঝতে পারছেন বন্ধু?
আমার বাবার সেরিব্রাল স্ট্রোক, দেশের কৃষকসমস্যা আর আমার প্রাচীন যুগের গণিকা হওয়ার বাসনা, এই তিন ঘটনার মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র আছে? এটা কি গবেষণার বিষয় হতে পারে? এ রকম সাতপাঁচ ভাবনায় আমার মাথাটা একেবারে জ্যাম হয়ে আছে। এটা হল মাথার ব্যাপার। ব্যামোও বলতে পারেন। কোনও অ্যাভিনিউ পাচ্ছি না।
এর পাশাপাশি আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সুখী হওয়ার অভিজ্ঞতা— এও সমস্যা, আমাকে সোমার প্রতি আরও অনুরাগী করে তুলেছে— আমার ভালোলাগা জানার পর সোমা বলেছিল, ‘এই হল যৌনতা! তোর মাস্টারমশাই বলছিলেন না, মানবিক যৌনতা— এটাকে, মানে এই অভিজ্ঞতাকে তুই তা-ই ভাবতে পারিস!’
আমি জানি না, এই সব সমস্যার কী সমাধান হতে পারে, আপনিও-বা কী ভাবছেন। জানার উপায় নেই। আমি সোমাকেই ব্যাপারটা বললাম। সোমা বলল, ‘সেরিব্রাল স্ট্রোক— একটি ঘটনা। অতএব তার কার্যকারণ আছে। কৃষক ও নারী— এই দুই বিষয় আজও রয়েছে তাদের ইতিহাস সমেত!’ আমি সায় দিলে সে বলল, ‘তা হলে ব্যক্তির ওপরে তার প্রভাব পড়া স্বাভাবিক!’ কেন জানি না ওই কথায় আমি শিহরিত হলাম। কিন্তু তার প্রকাশ ঘটতে দিলাম না। বললাম, ‘আমার করণীয় কী?’ সোমা বলল, ‘তপস্যা, আই মিন গবেষণা!’
‘মানে তুই বলছিস এ বিষয়ে থিসিস প্রপোজাল তৈরি করতে হবে!’
কী ভেবে সে বলল, ‘তা করতে পারিস।’
‘বিষয়টা অ্যাক্সেপ্ট হবে?’
‘এ গবেষণা হবে আকাদেমির বাইরে— যেমন আমাদের সিদ্ধার্থ করেছিলেন!’
আমি অবাক হয়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম, সে ঠিক কী বলতে চাইছে। সোমা বলল, ‘জরা-ব্যাধি-মৃত্যু— জীবনের এই অনিবার্য পরিণতি থেকে মানুষের মুক্তি— এই তো ছিল রাজপুত্র সিদ্ধার্থের গবেষণার বিষয়! তখন-কিন্তু আকাদেমি ছিল না, আবার ছিলও— এক-একজন গুরু ছিলেন এক-একটা জীবন্ত আকাদেমি। সেই সব আকাদেমি ঘেঁটে-ঘুটে তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন নিজের গুরু… বোঝা গেল?’
আবারও শিহরণ জাগল। কী সুন্দর দেখাচ্ছে সোমাকে! সমস্ত মুখে কী এক দীপ্তি ছড়িয়ে আছে। আমি একটা তুলনা খুঁজছিলাম। ছবিতে দেখা গ্রিক ভাস্কর্য— দু’একটা মনে পড়ল বটে কিন্তু আমি যা দেখছি তা তাদের মতো মোটেই নয়… তখন সোমা জিজ্ঞেস করল, ‘কী-রে, কিছু ভাবছিস মনে হচ্ছে?’
আমি আবেগমাখা স্বরে বললাম, ‘দেখছি— তোকে-না, মানে তোর মুখখানা সরস্বতী প্রতিমার মতো লাগছে!’
দুখি-দুখি মুখ করে সে বলল, ‘তার মানে দেবীজ্ঞানে তুই আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিস!’
না-ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। কিন্তু সোমা সেই আশ্লেষ গ্রহণ করতে পারেনি, যেন একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল। নিজেকে মুক্ত করে সে বলেছিল, ‘তোর ভাবনাটা বেশ অভিনব— জানিস তো সিদ্ধার্থর বাবা কৃষিজীবী ছিলেন?’
আমি সবিস্ময়ে মাথা নাড়লাম। সে বলল, ‘তোকে একটা বই দেব, জেনে যাবি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘অভিনব কেন?’ সে বলল, ‘গুছিয়ে বলতে পারব না তবে তোর বাবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের যে কারণই থাকুক না কেন আর তুই নিজেকে যতই অপরাধী ভাবিস না কেন, তাকে ঐতিহাসিকভাবে কৃষক-সমস্যা ও নারী-সমস্যার সঙ্গে লিঙ্ক করা যায়— এটাই ভাবনার অভিনবত্ব।’
আরও পড়ুন: আম চাষ: ইতিহাস-বৃক্ষ ঘেঁটে

‘কিন্তু— এটা কেবল আমার মনে হওয়া!’
‘ঠিক। কিন্তু মনে হওয়াটা কোথা থেকে এলো?’
সোমার কথা বলার ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগছে। প্রায় চার বছরের বন্ধুত্ব— এমনটি দেখিনি। নতুন মনে হচ্ছে।
‘এলো পরিপার্শ্ব থেকে— এখনি এল তা-কিন্তু নয়, এসেছে কবে আমরা তা জানি না, কার্যকারণে আজ তার প্রকাশ হল মাত্র!’
ওর মুখের দিকে মুগ্ধ চেয়ে থেকে বললাম, ‘তুই এভাবে কথা বলতে শিখলি কবে?’
‘এই তো আজই— এভাবে কথা বলা, এই তো প্রথম ঘটল তোর সঙ্গে, তাই না! ভঙ্গিটা অবশ্য বাবার কাছ থেকে পাওয়া।’
হঠাৎ যেন, আমার মনে হল, আলোর উজ্জ্বলতা কমে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা কার কাছ থেকে পেয়েছিলেন?’
‘বুদ্ধের শিক্ষা থেকে, পরম্পরা— এটা আমার অনুমান।’ বলে সোমা চোখ বন্ধ করল। যেন বুদ্ধকে স্মরণ করছে। সোমার ওই মুখ দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। যেন আমি আবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠলাম। আমার বলতে ইচ্ছে হল, আই লাভ ইউ! কিন্তু সামলে নিলাম। সোমা আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে— এটা আমি অনুভব করেছি, নিঃসংকোচে বলতেও পারি। তার মুখে-কিন্তু ওই ক্লিশে কথাটা শুনিনি কখনও। তা হলে আমি কীভাবে বলতে পারি?
কখন সে চোখ মেলে আমাকে অন্যমনস্ক দেখেছে কে জানে— খেয়াল হতেই দেখলাম কেমন এক করুণার দৃষ্টি সে ছড়িয়েছে আমার মুখের ওপর। বলল, ‘কী ভাবছিলি?’ নিজেকে আড়ালে রেখে বললাম, ‘ভাবছিলাম, মানুষ আর একজন মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করতে পারে?’
‘হঠাৎ এই উদ্ভট ভাবনা?’
‘উদ্ভট বলছিস কেন?’
‘তো কী— সিনেমা, টিভি সিরিয়াল, গল্প-উপন্যাসে তো বলেই দিচ্ছে— আমি তোমাকে ভালোবাসি! আই এল ইউ…’
‘তুই কাউকে বলেছিস?’
‘না।’ কেমন যেন গম্ভীর শোনাল কথাটা তারপর সে কৌতূহল দেখাল, ‘তুই ভালোবাসছিস নাকি কাউকে?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, ‘তোর কাজকর্মের মাধ্যমে তাকে অনুভব করতে দে! লেট হিম ফিল!’ পরক্ষণেই তার গলার স্বর পালটে গেল, ‘তুই কিন্তু গবেষণার কথা ভাবছিলি!’ এবং তাকে চিন্তিত দেখলাম। নিশ্চিন্ত করার জন্য বললাম, ‘ওসব কিছু না। বইটা কবে দিচ্ছিস?’
বন্ধু! আমার সমস্যা কী— বুঝতে পারছেন? বা আমাকে? এক দিকে অস্পষ্ট যৌনচেতনা, ব্যক্তিগত; আর-এক দিকে সমাজচেতনা… নিজেকে নিয়েও একটা জিজ্ঞাসা— এ জীবন নিয়ে আমার করণীয় কী? আচ্ছা আর একটা গল্প বলা যাক— এ গল্পটাও লেখা হয়েছিল কাউকে উদ্দেশ্য করে, আমার মনের গল্প— জাস্ট কপি পেস্ট করে দেব, মানে জেরক্স সেঁটে দেব।
জীবনের নিরন্তর বিকাশের এক জৈব পর্ব গল্পের একটা নাম দেওয়া যাক, জন্মদিনের গল্প
যখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি তখন জন্মদিনে বাবা একবার ঈশপের গল্প আর-একবার জাতকের গল্প উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও বইয়েরই দু’তিনটের বেশি গল্প পড়া হয়নি। এটা জেনে বাবা দুঃখ পেতেন। আমি যুক্তি দেখাতাম, পড়াশোনার চাপ। বাবা খুব নরমভাবে বলতেন, এখনও মনে আছে, বলতেন ‘একটা গল্প পড়তে কত সময় লাগে? খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা! দশ মিনিট কার্টুন দেখা অফ করলে, সপ্তাহে একটা গল্প তো পড়া যায়! এই চাপটা নেওয়া যায় কি না ভেবে দেখতে পারো!’ এটা বলার পর আর কোনো কথা হত না। অনেকদিন পরে পরে খোঁজ নিলে বলতাম, একটা-দু’টো পড়েছি। বাবা বোধহয় বুঝতে পারতেন, আমি মিথ্যে বলছি। তবে হ্যাঁ, একটাও যে পড়িনি, তা নয়। সম্ভবত, ঠিক মনে নেই, সেভেন থেকেই হবে, জন্মদিনে মাথায় ধানদুব্বো দেওয়ার সময়, সকলের দেওয়া হয়ে গেলে বাবা বলতেন, ‘এই কেউ চলে যেও না, ছোট্ট একটা গল্প বলব, শোনো!’ সেই ট্র্যাডিশনটা এখনও আছে। কেবল আমার ছাব্বিশতম জন্মদিনে বাবা সেই সুযোগ পাননি। ভেবে দেখেছি গত আট-নয় বছরে বলা গল্পগুলো খুব একটা মনে নেই, কেবল একটি গল্প মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে আর আশ্চর্য এই যে, বাবা পুরো ‘গল্প’টা বলেছিলেন চোখ বন্ধ করে, আমি সেই মূর্তিটা দেখতে পাই, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যেন চলচ্চিত্র, বাবা বলছেন:
এটা ঠিক গল্প না, ঘটনা; আমার এক বন্ধুর জীবনের ঘটনা; তোমরা তাকে দেখনি। আমাদের বিয়ের সময় এসেছিল। সেই একবারই। তোমার মায়েরও মনে থাকার কথা নয়। সেই বন্ধুর মেয়ে, ক্লাস টেনে ভর্তি হওয়ার আগেই, একটি হৃদয় বিদারক চিঠি লিখে এক ‘উদ্বাস্তু’ ছেলের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ে। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে সে ব্যাপারটা জানায়। আমি তাকে পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দিই। সে বলে, ‘পুলিশ হয়তো খুঁজেপেতে মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু এতটা বয়স পর্যন্ত যে মেয়ে আমাদের কাছে থাকল, তাকে তো আমরা ধরে রাখতে পারিনি! চিঠির ছত্রে ছত্রে আমাদের ওপর তার অভিমান, অভিযোগ— দাদাকে বেশি ভালোবাসার— আর-কি ধরে রাখতে পারব তাকে?’
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বন্ধু যেন আমাকেই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিল, ‘চিন্তা করিস না, জীবনের নিরন্তর বিকাশের এ একটা পর্যায়, জৈব পর্যায়— এটা পাশব অবস্থা। এই অবস্থা থেকে মানবিক পর্যায়ে পৌঁছনোর পথ কাটতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কীভাবে সামলানো যাবে— ভাবছি; ডোন্ট ও’রি!’ (বাবার বলা কথাটা এভাবেই আমার বয়ান হয়ে উঠেছে আমি সেভাবেই লিখলাম, মানে ভাষাটা আমার)।
আরও পড়ুন: ইসরাইল-প্যালেস্তাইন সংঘাত, একপেশে মিডিয়া

এক বছরের মাথায় মেয়ে মা হল। আর আট-ন’বছর পর সন্তান নিয়ে মেয়ে ফিরে এলো বাপের কাছে। এখন মেয়ে আর নাতনির খোঁজ নিলে বন্ধু বলে, ‘কোনও গল্প নেই। কোনও গল্প আমিও তৈরি করতে পারছি না। বরং নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে— ছেলের বিয়ের ব্যাপারে। প্রথম দিকে, সকলেই মেয়ের খোঁজ নিত, সহানুভূতি দেখাত, বলত ‘তোমার মতো মানুষের মেয়ে— কি ভুল যে করল!’ কারও বাড়িতে না যাওয়ার এটা একটা কারণ— এই কারণেই সে আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে।
বাবা চোখ খুলে বললেন, ‘এই!’ যেন আকাশ দেখতে চেয়ে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেছে ছাদে তার সঙ্গে তিনি দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেছিলেন। আর কেন জানি না, খেয়াল করে দেখেছি মা আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে জিজ্ঞাসা।
একদিন আবিষ্কার করলাম, মাসিকের সময় এই গল্পটা মনে পড়ে। এখন সেই ‘সময়’ চলছে। আর তোমাকে লিখছি।
আমার বাবা কথা বলার সুযোগ পেলেই, তত্ত্বকথা বলতেন। এখনও বলেন, তবে কমে গেছে। সেই সব কথা থেকে জীবন, বেঁচে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে কেমন যেন একটা বোধ তৈরি হয়েছে। যেমন ধরো, একটা কুকুরের সঙ্গে আমার বেঁচে থাকার ফারাকটা কোথায়— এটা যদি আমি খুঁজতে চাই, তবে মিল আছে— এটা-কিন্তু স্বীকার করেই নিলাম! এর পরের কথাটাই মারাত্মক। ‘কিন্তু মিল কোথায়, সেটাই জানো না!’ আচ্ছা, তুমি কি জানো? ধ্যুৎ এটা কি আমাদের জানার কথা!
তোমাকে একটা কথা বলি, আমার মনে হয়, বাবার মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে, নইলে এ রকম কেউ বলতে পারে, ‘যদি নিজেকে জানতে চাও তবে কুকুরকে স্টাডি করো!’ মানে কম্পারেটিভ স্টাডি। যদি ধরে নিই একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ও-রকম ভাবতে পারে না, তা হলে আমার কেন মনে হয় আমার মধ্যে কুকুর-স্বভাব আছে! কী করে বুঝলাম? ঘটনাটা— বললে তুমি বুঝতে পারবে। তখন থার্ড ইয়ার। আমাদের পাঁচ-ছ’জনের একটা গ্রুপ ছিল। গ্রুপের একটি ছেলেকে দেখতে দেখতে… তাকে কেমন এক দুর্বল ভীতু কুকুর হয়ে যেতে দেখতাম। আবার একটি মেয়ে, তাকে কেমন যেন খেঁকি হয়ে যেতে দেখতাম। আর এর ফলে যেটা হত আয়নায় নিজের মুখকেও কখনো কখনো কুকুর হয়ে যেতে দেখেছি।
যাই হোক এই যে ‘বিশেষ সময়’ চলছে, আমার মনে পড়ছে সেই মেয়েটির কথা, ঠিকভাবে বললে, ভাবছি মেয়েটির বাবার কথা, ‘জীবনের নিরন্তর বিকাশ’— আমি এখন বিকাশের কোন পর্যায়ে? খুব অনেস্টলি বলছি, কাল তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছি। একেবারে ব্লু ফিল্ম মার্কা স্বপ্ন।
কিন্তু আজ গণতন্ত্রের দাবিতে যে র্যালি ছিল, সেখানে আমি তোমাকে দেখলাম না। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। স্বপ্নে আছ, বাট রিয়েলিটিতে নেই! কল্পনায় দেখি তুমি আমার সামনে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি গণতন্ত্র চাও না? তুমি বললে, না। আর আমার মনে পড়ল, একদিন কথায় কথায় তুমি বলেছিলে, ‘এখনও বসুন্ধরা বীরভোগ্যা!’ শক্তপোক্ত কাঠিন্যে ভরা তোমার মুখটাও মনে করতে পারলাম। আমি বোধহয় থেমে ছিলাম। যেন কোথাও ভুল হয়ে গেছে। অসহায় লাগছিল…
কেউ একজন আমাকে মিছিলের গতিতে জুড়ে দিল। নিজের অজান্তেই যেন তখনকার স্লোগানে ধুয়ো দিয়ে উঠলাম, বন্ধ করো, বন্ধ করো! এখন মনে করতে পারছি, স্লোগান ছিল দৃষ্টিহরণ আর হত্যার বিরুদ্ধে (সংযোজন— কাশ্মীর ইস্যু)। আর তখনি আমাকে মিছিলে জুড়ে দিয়েছিল যে ছেলেটি তাকে দেখলাম। সে আমাদের গ্রুপের সেই দুর্বল ভীতু ছেলে… সে তখনও লাইন ঠিক রাখার কাজ করছে। ব্যস্ত রাস্তা, যতটা সম্ভব মানুষের যাতায়াত স্বাভাবিক রেখে, মিছিলের মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাজটার গুরুত্ব আছে বলে মনে হল। সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটা করছে। আর যেটা ঘটল, আমার চেনা মিছিল ম্যানেজ করা ছেলেটি কেমন অচেনা হয়ে গেল। মিছিল সামাল দিতে দিতে সে কখনো দূরে সরে যাচ্ছিল, এক বার নিকটে আসলেও তাকে ‘অচেনা’ই দেখলাম। ছেলেটিকে আমি চোখে চোখে রাখছিলাম, চোখাচোখি হতেই, পরে ভেবে দেখেছি, আমি আমার জীবনের সব চেয়ে সুন্দর হাসিটি হেসেছিলাম; তার অস্ফুট হাসিমাখা চোখ যেন প্রত্যুত্তর দিল— এই মুহূর্তে দৃশ্যটা ফিরে দেখতে গিয়ে দেখছি, এক আশ্চর্য মুদ্রায় তার ডানহাত আমার দিকে উঠেছে…
মিছিল শেষে, তখন বক্তব্য রাখা হচ্ছিল। আমাদের দেখা হল। আমরা যে পরস্পরকে খুঁজছিলাম, দেখা হওয়ার মুহূর্তেই সেটা বুঝতে পারলাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল একান্তে কোথাও বসতে। ছেলেটি যেন আমার মনের কথা জেনে বলল, ‘আমরা ওইখানটায় বসতে পারি!’ আমরা বসলাম। আমাদের গ্রুপের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসেছি, গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে কারও সঙ্গে বসাও হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গে কখনও এত কাছে বসা হয়নি।
আমরা পরস্পরকে দেখছিলাম। দেখতে দেখতে ছেলেটি বলে উঠল, ‘আজ গণতন্ত্র দিবস— আমার জীবনের ক্যালেন্ডারে একটি বিশেষ দিন হয়ে উঠল।’ আমি বলে উঠলাম, ‘আমারও!’ তারপর কী-ভেবে আমি তার কাছে একটা গল্প শুনতে চাইলাম। যেকোনো গল্প। যেন তাকে সমস্যায় ফেলেছি। বললাম, ‘তুমি বোধহয় গল্প জানো না! থাক!’
আরও পড়ুন: ‘উন্নয়নবিরোধী’ এক প্রকৃতিপ্রেমিক মানবদরদি সুন্দরলাল বহুগুনা

সে বলল, ‘না তা নয়, ভাবছিলাম, কী গল্প শোনাব! শোনো তবে!’ বলে সে যে গল্পটা বলেছিল, সেটা লিখছি এখানে।
এক দেশে ঈশ্বরবিশ্বাসী এক মানুষ বেঁচে থাকার আশ্চর্য এক পথ উদ্ভাবন করেছিলেন।
তাঁর মত প্রচার করে বেড়াতেন। মূলত অহিংসা আর ক্ষমার সেই পথ চলায় শত্রুর অভাব হল না। নানাভাবে, আজকের ভাষায় যাকে বলে ফাঁদে ফেলা, তাঁকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হল। এক বার ব্যভিচারে অভিযুক্ত এক মহিলাকে তাঁর কাছে আনা হল বিচারের জন্য।
তখন শাস্ত্রমতে ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা। অভিযোগকারীরা সেটাই চায়। বুঝতে পেরে মানুষটি বললেন, ‘তাই হবে! তবে পাপ যাকে এখনও স্পর্শ করেনি, তিনিই প্রথম পাথরটা ছুড়বেন!’ দেখা গেল, এক সময় সেই মহিলা ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। তিনি মহিলাকে বললেন, ‘তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। তুমিও যাও! তবে আর পাপ করো না!’
তার পর? ছেলেটি বেশ চিন্তায় পড়ল। আমিও ভাবলাম এই গল্প সে কেন শোনাল। কয়েক মুহূর্ত পর সে বলল, ‘তার পর— আমার আর-মনে পড়ছে না। মেয়েটি বোধ হয় চলেই গিয়েছিল… কিন্তু তার পর?’
তখন সন্ধ্যা নামছে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা। কেন যে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হল, তাও বুঝতে পারলাম না। উপরের আকাশ থেকে রঙিন মেঘ আলো ছড়াচ্ছিল। সেই রঙের মায়ায় না কি আমার অশ্রুবাষ্পের কারসাজিতে, কে জানে, ছেলেটি আশ্চর্য এক শিহরণ জাগিয়েছিল!
মাস্টার্স করার সময় একদিন মনে হল ছেলেটি হারিয়ে গেছে বা হতে পারে আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। বাট, সে-কিন্তু— কাব্য করে বলতে পারি, আমার বুকের মধ্যে রয়েছে! আর চলার পথে মনে হয়, আমার চোখ খুঁজছে তাকে। জানি না তাকে খুঁজতে গিয়ে কি না, আমিও হারিয়ে যাচ্ছি তার জীবন থেকে… কিন্তু গল্পটা থেকে যাচ্ছে— ভাবতে চেষ্টা করি, আমি কেন গল্প শুনতে চেয়েছিলাম, কেনই বা সে ওই গল্প বলেছিল!
তুমি কি বুঝতে পারছ, মন?
গল্পের নাম-কিন্তু হতে পারে— একটি মনের জন্মকথা।
ক্রমশ…
সুরঞ্জন প্রামাণিক-এর জন্ম ৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৬২ (১৯৫৫)। প্রথাগত শিক্ষা বিএ। পেশা সরকারি চাকরি (অবসরপ্রাপ্ত)। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ১৯৯২-এ। ঘোষিত ভাবেই লিটল ম্যাগাজিনের গল্পকার। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ সংকলন। নানান আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় তিনি মনস্বী গল্পকার— ‘মনকে সজাগ রেখে গল্প পাঠ করিয়ে নেন’। তাঁর লেখা পড়তে মগজের চর্চা করতেই হয়। আমাদের গোপন এবং প্রকাশ্য… স্বপ্ন এবং বাস্তব সবই তাঁর কলমে বিদ্ধ। সুরঞ্জনের লেখা কখনো পাঠককে বোবা-কালা-অন্ধ ক’রে দেয় না, বরং চৈতন্যের মধ্যেই যেন ধাক্কা দিতে চায়। যা আমাদের অনুভবকে জারিত করে, মননকে ঋদ্ধ করে এবং পরিণামে আমরা আমাদের প্রকৃত সত্যকে শনাক্ত করতে পারি। তিনি ‘কবি’, ‘তাঁর গদ্যে জ্যোৎস্না নামে’। তিনি ‘চিত্রকর’, ‘গল্পের শরীরের কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে একটি ছবির নির্মাণ করতে থাকে।’ ‘সোনালি ডানার চিল’-এর জন্য পেয়েছেন সমর মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১২) ও ‘বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর সামগ্রিক কৃতির প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি তাঁকে অর্পণ করেছে শান্তি সাহা স্মারক পুরস্কার (২০১৪)।