সুরঞ্জন প্রামাণিক
মানবিক যৌনতা-অনুসন্ধান যেন এক অভিযান
যৌনতা— এ বিষয়ে একটা ধারণা যে আমি তৈরি করে নিয়েছি, বুঝতেই পারছ এবং তা আর-তিনটে লেকচারে আমি আরও ভালোভাবে মেয়েদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি কিন্তু যৌনতার সঙ্গে ‘মানবিক’ শব্দটা এখনও জুড়ে দিতে পারিনি। শেষপর্যন্ত আবার হেড স্যারের বাড়িতে গেলাম। সব শুনে তিনি জানালেন যে, তাঁর ধারণা অস্পষ্ট! আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, ‘সেটাই বলুন না স্যার!’ তিনি রাজি হলেন না। কিন্তু আমাকে ‘রেফার’ করলেন কোনও এক সুজন মিত্রের কাছে। তিনি স্যারের বন্ধু। জানা গেল, তাঁর মুখেই স্যার প্রথম ‘মানবিক যৌনতা’ কথাটা শোনেন এবং পরে তাঁর লেখাতেও দেখেছেন শব্দটা। সুজন মিত্র— নামটা চেনা মনে হল, কিন্তু মনে করতে পারলাম না। স্যারের ধারণা, সুজনবাবু ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে পারবেন।
আমার পরিষ্কার হওয়া জরুরি। কেন জানি না আমার মনে হয়েছে, পাঁচ জনের সঙ্গে বসার আগে ‘মানবিক যৌনতা’— ব্যাপারটা আমাকে বুঝে নিতে হবে! কেন-না সব ঘটনার মধ্যে আমি ‘যৌনতা’র উপস্থিতি টের পাচ্ছি— হয় সংলগ্ন না হয় বিযুক্ত বা বিমুক্ত হয়ে আছে যৌনতা, দেখতে পাচ্ছি! এমনকী স্বপ্নে আমি আমি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ছিলাম। তা ছাড়া থানাকে জানিয়েছি আমি আরও প্রোগ্রাম পেতে চাই!
পরের দিনই সুজন মিত্রের সঙ্গে আমি দেখা করতে গেলাম। এক ভদ্রলোক দরজা খুলে বললেন, ‘বলুন!’ ‘আমি সুজন মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি’ জানাতেই তিনি বললেন, ‘আমিই সুজন। আসুন!’
দেখে খুব একটা ভক্তি-শ্রদ্ধা জাগল না। বিষণ্ণ টাইপের সাদামাটা মানুষ। মনে হল তিনি কোনও সমস্যায় আছেন। সুজন মিত্র আমাকে নিয়ে তাঁর স্টাডিরুমে বসালেন। ঘরের তিন দেওয়ালে জানলা ছেড়ে বইয়ের র্যাক। ক্যালেন্ডার-ছবি কিচ্ছু নেই। একটামাত্র স্কেচ-রবীন্দ্রনাথ। আর কম্পিউটার-স্যুইচবোর্ডের উপরে একটা ছোট্ট পিতলের বুদ্ধমূর্তি। ঘরের মাঝখানে একটা সিঙ্গল খাট। তার উপরে নিজে বসলেন। বসেই একটা চেয়ার দেখিয়ে আমাকে ইঙ্গিতে বসার কথা বললেন। আমি বসতেই বললেন, ‘বলুন!’
আরও পড়ুন: প্রাচীন ইটের ডাকবাক্স

(যে কথাগুলো এখন লেখা হবে তা স্মৃতি ও রেকর্ডিং শুনে)। আমি স্যারের কথা বললাম। আলোচনার বিষয় জেনে সুজনস্যার বললেন, ‘আপনি কি এ বিষয়ে গবেষণা করছেন?’
‘না।’ ঘটনাক্রম বলতে বলতে এক সময় বললাম, ‘আমার এই জানার ইচ্ছাটা প্রথমে আমি স্যারকে জানাই, কিছু বইপত্র দিয়ে তিনি আমাকে যৌনতা বুঝতে বলেন এবং তারপর— যৌনতা সম্বন্ধে সাধারণ একটা ধারণা নিয়ে এই গত কালই আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম— স্যারের সঙ্গে অনেক কথাই হল কিন্তু শেষে তিনি জানালেন, তাঁর কাছে ব্যাপারটা এখনও অস্পষ্ট আর যে হেতু কথাটা আপনার কাছ থেকে তিনি প্রথম শুনেছেন, তাঁর বিশ্বাস, আপনিই আমাকে যথার্থ আলোকিত করতে পারবেন!’
‘জানি না পারব কি না। চেষ্টা করব! তার আগে, আপনি আমাকে বলুন, মানুষের উৎপত্তি বিষয়ে আপনার ধারণা কী!’
‘স্যার, প্লিজ! আমার অস্বস্তি হচ্ছে— ‘তুমি’ সম্বোধনে কথা বলুন, প্লিজ! ভালো লাগবে।’
‘অস্বস্তি যে আমারও হচ্ছে, আমি তো কখনও স্যার ছিলাম না, পাতি কেরানি— স্যারের বন্ধু বলে তুমি আমাকে স্যার বলছ! ঠিক আছে। বলো!’
‘আমার ধারণা স্যার ডারউইন-অনুসারী।’
‘বেশ! মানে তুমি জিরাফে আছ— এর অর্থ, পশুজগৎ থেকে, যথার্থভাবে বললে, জন্তুজগৎ থেকে মানুষের উৎপত্তি!’
আমি সায় জানালাম বটে, সংশয় থেকে গেল— তার মানে পশুজগৎ আর জন্তুজগৎ এক নয়!
তিনি বললেন, ‘এই বার যৌনতা সম্বন্ধে তোমার ধারণা বলতে পারো!’
‘কিন্তু স্যার, তার আগে, জানতে চাইছি, পশুজগৎ আর জন্তুজগতের মধ্যে কি পার্থক্য আছে?’
আরও পড়ুন: কৃষ্ণকলি

‘জীব জন্তু পশু— আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এরা একই অর্থ প্রকাশ করছে কিন্তু ব্যুৎপত্তি অনুসারে জীব মানে যে বেঁচে থাকে, জন্তুর মানে যে জন্মে আর যাকে বন্ধন করা যায় সে-ই পশু— বোঝা গেল?’ আমাকে চুপ থাকতে দেখে তিনি বললেন, ‘পশু জন্মে ও বেঁচে থাকে, তার মানে পশুকে আমরা জন্তু ও জীব বলতে পারি, একইভাবে মানুষ মানে জীব ও জন্তু— জন্ম ও বাঁচার নিরিখে। আবার পশুকে বেঁধেছে মানুষ— যে হেতু জন্তু থেকে মানুষ ও পশু উভয়েরই উৎপত্তি, সে হেতু মানুষের জন্ম জন্তুজগৎ থেকে বললেই যথার্থ বলা হয়। বোঝা গেল?’
‘হ্যাঁ, স্যার— এত ভালো বুঝেছি যে, মানুষ ইক্যুয়াল ট্যু পশু— আমার মধ্যে এই ইক্যোয়েশন তৈরি হয়ে গেল এইমাত্র!’
‘কী রকম?’
তখন আমি একটা কাগজে লিখলাম, পশু = জন্তু + জীব, মানুষ = জন্তু + জীব; তার পর বললাম, ‘বীজগণিতের নিয়মে বিয়োগ করলে দেখুন পশু মাইনাস মানুষ ইক্যুয়াল ট্যু জিরো হবে, দ্যাট ইজ পশু ইজ ইক্যুয়াল ট্যু মানুষ!’
‘বাঃ!’ আমার মুখের দিকে অদ্ভুত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এবার বলো!’
আমি বললাম, ‘স্যার, একটা লেখা থেকে আমি জেনেছি, যোনি থেকে যৌন, মানে যোনিজ যা কিছু সবই বিশেষণ আর বিশেষণ থেকে ফের যখন বিশেষ্য তৈরি হয়েছে— যৌনতা, তখন তার মানে দাঁড়িয়েছে যোনি সম্বন্ধে যা কিছু ধারণা…’ প্রথম দর্শনে যাকে মোটেই ইম্প্রেসিভ দেখায়নি, সেই তিনিই ভীষণ দর্শনীয় হয়ে উঠলেন! তিনি জানতে চাইলেন, ‘সেই লেখায় কি তুমি যা বললে এ সব লেখা ছিল?’
‘ঠিক এই ল্যাঙ্গুয়েজে ছিল না, কিন্তু স্যার, লেখার মধ্য থেকে আমি এই ভাবনা পেয়েছি!’
তাঁকে আরও উদ্দীপিত হতে দেখলাম, ‘তার পর? তার পর— তোমার ধারণা?’
‘হ্যাঁ, এই ভাবনা থেকেই আমার মনে হয়েছে, যোনি সম্বন্ধে যা কিছু সামাজিক ধারণা তা পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি করা হয়েছে।’
এই কথা শোনার পর সুজন মিত্রের দু’হাতে অদ্ভুত এক মুদ্রা দেখা দিল, যেন কাউকে তিনি আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চাইছেন, এ রকমই মনে হল আর দেখলাম, হাতদু’টো পরস্পর জড়িয়ে বুকে শান্ত লেপটে আছে। চোখ বন্ধ, যেন গভীর কোনও অনুভবে আচ্ছন্ন। তার পর চোখ মেলে বললেন, ‘তুমি ঠিকই ভেবেছ!’ উঠে দাঁড়ালেন। পুব দিকের র্যাক থেকে একটা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এসে বসলেন, একটা জায়গা মেলে ধরলেন আমার সামনে, ‘তুমি কি এই লেখাটা পড়েছ?’ নির্দিষ্ট জায়গা আঙুল দিয়ে দেখালেন। আমার সব মনে পড়ল। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ স্যার!’ বললাম। দারুণ আলোকিত দেখাচ্ছে তাঁর মুখ! খোলা অবস্থায় বইটাকে টেবিলের ওপর রাখলেন, ‘যে কথাটা আমি বলতে চেয়েছিলাম, পারিনি, তুমি পেরেছ!’ তার মানে পত্রিকায় আমি সুজন স্যারের লেখাই পড়েছিলাম— লেখাটা এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে।
আমার মধ্যেও এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করছিল, বললাম, ‘থ্যাঙ্কু স্যার!’
তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন।
তার পর অনেকক্ষণ আমরা কোনও কথা বলিনি। সেই না কথা বলা সময়টাতে আমাদের টি-ব্রেক হয়ে গেল। সুজন মিত্রের স্ত্রী চা-বিস্কুট নিয়ে ঢুকতেই ঘরের ভিতর শব্দ ফিরে এলো, ‘এসো!’ আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘এই সংসারের অন্যতম স্থপতি! অণিমা।’ হাসি-নমস্কার বিনিময়ের মধ্যে বললাম, ‘আমি বিনতা।’ চায়ের কাপ তুলে নিয়ে সুজন মিত্র আমাকে নিতে ইশারা করে স্ত্রীকে বললেন, ‘খুব মজার মেয়ে, নিজে বিয়ে-থা করবে না বলে ঠিক করেছে অথচ ও গবেষণা করছে যৌনতা নিয়ে—’ আমার একটু খটকা লাগল পরক্ষণেই তা অবশ্য কেটে গেল, ‘যদিও ব্যাপারটা আকাদেমিক নয়, (আমার দিকে তাকিয়ে) তবু, গবেষণাই!’ চোখও যেন কিছু বলল।
আরও পড়ুন: বর্ষা সিরিজ (পরবর্তী অংশ)

অণিমার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘এ বিষয়েই একটু কথা বলতে এসেছি স্যারের সঙ্গে!’
‘বাঃ! তোমরা কথা বলো! পরে কথা হবে।’ বলে স্যারের স্ত্রী বেরিয়ে গেলেন।
তার পর আমাদের কথা আবার শুরু হল। তিনি শুরু করলেন, ‘জন্তুজগৎ থেকে মানুষের উৎপত্তি হলেও জন্তুদের-কিন্তু যৌনতা নেই! অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে।’
আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, এটা বুঝেই যেন বললেন, ‘তবে জনন আছে, সম্ভবত জননের জন্য, মানুষ যাকে চিন্তা বলে তা জন্তুদের করতে হয় না, তাদের ব্যাপারটা প্রবৃত্তিগত এবং প্রবৃত্তিকে উসকানি দেয় প্রকৃতির ঋতুজ পরিবর্তন।’
‘তার মানে সমস্ত ব্যাপারটাই— বলতে হবে প্রকৃতিগত!’
‘একদম! প্রকৃতিই হল, দ্য সুপ্রিম! কিন্তু প্রকৃতি থেকে জন্ম নেওয়া মানুষ হয়ে উঠেছে প্রকৃতির প্রভু কিন্তু প্রকৃতির উসকানি থেকে, বলতে পারো পাশব প্রবৃত্তি থেকে সে মুক্ত হতে পারেনি। মনুষ্যজাতির ট্র্যাজেডি এইখানে।’
আমার চোখেমুখে কৌতূহল ও শোনার অপেক্ষা, একইসঙ্গে মনে পড়ল সেলিগম্যানের কথা। তিনি বললেন, ‘কেন-না, মানুষের অন্তঃপ্রকৃতি প্রকৃতি-সংলগ্ন হয়ে আছে— প্রকৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ আমাদের এই দেহ, প্রকৃতির নিয়মেই প্রজননের জন্য দেহর জেগে ওঠা— আমরা বুদ্ধি দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারি কিন্তু যৌনতাকে আমরা ঘুম পাড়াতে পারি না! আমার কথা বুঝতে পারছ বিনতা?’ আমি একটু অন্যমনস্কভাবে বললাম, ‘হ্যাঁ স্যার!’
‘তোমার কোনও প্রশ্ন নেই?’
‘আছে— এই যে বললেন, যৌনতাকে আমরা ঘুম পাড়াতে পারি না— এই আমরা কি নির্বিশেষ, না আপনাকে ইনক্লুড করে কেবল পুরুষকেই বোঝালেন, না কি আমিও আছি এর মধ্যে?’
‘যৌনতা সম্বন্ধে তোমার ধারণাকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি, তাকে তো নির্বিশেষ বলতে পারি না!’
‘কিন্তু স্যার, পুরুষের ধ্যান-ধারণায় মেয়েরাও প্রভাবিত হতে পারে, যেমন আমরা গুজরাত দাঙ্গার রিপোর্টিংয়ে দেখেছি নারীনির্যাতনে পুরুষকে সহায়তা দিচ্ছে নারী, এমনকী গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষেত্র থেকেই তো তৈরি হয়েছে— নারীই নারীর শত্রু-কথাটা— এ সবের মধ্যে কি নারীর যৌনতা প্রকাশ পায় না?’
একটু ভেবে স্যার বললেন, ‘হুঁ, পায়— দুই নারীর ঝগড়ার মধ্যে কোট-আনকোট যোনি শব্দের নানান প্রতিশব্দের ব্যবহার মারাত্মক, শুনেছি!’
‘আর একটা কথা বলি স্যার!’ বলে আমি সেই ‘নিম্ফোম্যানিয়াক’ সিনেমার গল্পটা তাঁকে শোনালাম। শোনার পর অনেক ক্ষণ চুপ থেকে যেন গভীর কোনও ভাবনা থেকে জেগে উঠলেন। ঘরের চার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে তিনি আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘মনে পড়ছে, তোমার স্যার এই সিনেমাটার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন, তখনি আমার ভালো লাগেনি— আমি ঠিক জানি না মেয়েরা এ রকম কি না— এটা একটা গল্প হতে পারে যে গল্পের উদ্দেশ্য— জ্ঞান ও যৌনতাকে নেগেটিভ দেখানো বা নারীর যৌন আবেগের নেগেটিভ মিথ তৈরি করা— আচ্ছা, পরিচালক ছেলে না মেয়ে, জানো?’
আরও পড়ুন: আদিবাসীরা নাচবে না
‘না স্যার, খেয়াল করিনি!’
‘আমার ধারণা, এ সিনেমা পুরুষ তৈরি করেছে। যাই হোক, তুমি কি তোমার ধারণাকে বাতিল করছ?’ কেমন যেন বিমর্ষ দেখাল তাঁকে। বললাম, ‘না স্যার! তবে, ব্যাপারটাকে আমরা-কিন্তু নির্বিশেষও ভাবতে পারি!’
‘থ্যাঙ্কু’ বলে স্যার এক গভীর ভাবনায় যেন ডুবে গেলেন। একবুক শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা হলে সিনেমার মেয়েটির যৌনতা— এখানে যৌনতার আক্ষরিক অর্থ যোনির সুখ, অমানবিক বাট নট পাশবিক! কেন-না তার যৌন আকাঙ্ক্ষা নৈতিকতা বর্জিত কিন্তু অনৈতিক নয় বলেই মনে হচ্ছে আমার, সে সন্তানের জন্য মিলিত হচ্ছে না! এর থেকে তুমি কি মানবিক ধারণার কোনও ভিত্তি কল্পনা করতে পারো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ— নৈতিকতা!’
‘তা হলে’ বললেন তিনি, ‘মানবিক যৌনতা— এই ধারণায় আমরা সহজেই পৌঁছে গেলাম, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যোনি সম্বন্ধে যে কোনও চিন্তা ও কর্মই হল মানবিক যৌনতা!’
আমার সমস্ত শরীরে এক অজানা শিহরণ খেলে গেল, যেন সোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, বলে উঠলাম, ‘বাঃ! ক্লিয়ার!’ আমি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছি। চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘কিন্তু— ধারণায় তো পৌঁছনো গেল, ইন প্র্যাকটিস ইট ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট—’ তাঁর বলার ধরনটি, যেন তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন।
‘কিন্তু স্যার, এই সিনেমার গল্পে, ‘এফ’-চরিত্রকে তো আমরা মানবিক যৌনতার প্রতিভূ ভাবতে পারি!’ তখনও আমার সোমার কথা মনে পড়ল।
একটু ভেবে স্যার বললেন, ‘হ্যাঁ কিন্তু জোর করে আট থেকে আশির যোনি ব্যবহার— এটা ধর্ষণ, কিন্তু পনেরো বছরের উপরে যে কোনও বয়সের বিবাহিত স্ত্রীর যোনি জোর করে ব্যবহার করা, ধর্ষণের সংজ্ঞার মধ্যে পড়লেও, তা ধর্ষণ নয়, আমাদের দেশে— এক্ষেত্রে আইনই পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা থেকে নৈতিকতা বর্জনের সহায়তা দিয়েছে! বুঝতে পারছ, কেন ডিফিকাল্ট বলছি? ওঃহো! স্যরি! তুমি তো মানবিক যৌনতা বুঝতে চেয়েছ, ওক্যে! তুমি তো সেখানে পৌঁছে গেছই!’
‘আর একটু স্যার! কিছু ব্যতিক্রমী নারী ছাড়া যৌনতার ধারণা মূলত পুরুষের, পুরুষই আবার মানুষের মুক্তির জন্য সংসার ত্যাগ করেছেন; এর মানে কি তাঁরা নারীর যৌনতাকে ভয় পেয়ে বা যৌনতা বর্জন করে তপস্যা, সাধনা যাই বলুন, করতে বেরিয়েছিলেন? অথবা, এক কথায়, নারীই কি মানবমুক্তির অন্তরায়?’
অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘এ বিষয়ে অনুমান করাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না! তবে মানবমুক্তি নিয়ে আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে, মানবের বন্দিত্ব— ঠিক কোথায়? আর মানব মানে কি কেবলই পুরুষ?’
আরও পড়ুন: অবতারের মৃত্যু বনাম অবতারের মুক্তি

‘তা-ই তো মনে হয় স্যার!’ তখন বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধ বিষয়ে কিছু বই যা আমার আগেই নজরে পড়েছিল, সেসব আবারও নজর টানল, বললাম, ‘বুদ্ধের ধারণাও কি এ রকম ছিল?’
‘আর এক দিন তুমি এসো, তখন কথা বলা যাবে! খুব ক্লান্ত লাগছে।’
‘ঠিক আছে স্যার!’ আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসছি, পিছু ডাকলেন নাম ধরে। ফিরে দেখি তাঁর হাতে একটা কাগজ, বললেন, ‘এটা নিয়ে যাও!’ কাগজটা বাড়িয়ে ধরলেন, ‘ম্যারিটাল রেপ সম্বন্ধে এতে একটা লেখা আছে, তোমার কাজে লাগতে পারে!’ কগজটা নিয়ে আমি তাঁকে আরও এক বার ধন্যবাদ জানালাম।
সুজন মিত্রদের চারহাতি চওড়া পথটা পঁচিশ-কুড়ি পা কি-তার বেশি দূরত্বে গিয়ে বড় রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই আমার সঙ্গে সেই দূরত্ব পর্যন্ত এলেন, এটাই যেন লক্ষ্মণরেখা— ওরা দাঁড়িয়ে গেলেন, স্ত্রী বললেন, ‘আবার এসো!’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ কাকিমা, আসব! আপনিও-কিন্তু সেদিন আমাকে সময় দেবেন!’
তিনি ‘ঠিক আছে!’ বলার পরই সুজন মিত্র বললেন, ‘যে দিন আসবে, ফোন করে এসো, সারাদিনের জন্য! দুপুরের খাওয়া এখানেই সারবে!’ ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে আমি ঘাড় কাত করলাম।
ক্রমশ…
উপন্যাসের বাকি অংশগুলি পড়তে ক্লিক করুন:
সম্বুদ্ধজাতিকা (১ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (২য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৩য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৪র্থ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৫ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (ষষ্ঠ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৭ম অংশ)