সুরঞ্জন প্রামাণিক
সৃজনের নতুন পরিসর, চুক্তি না থাকা সম্পর্ক
বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে— এই উপলক্ষ্যে আমার মাথায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেইমতো আমি পাঁচ বন্ধুকে আমাদের বাড়িতে একটা ছুটির দিনে আসার কথা বলেছিলাম। বিয়ে না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্য-বিষয়ে কথা হবে, জানিয়েছিলাম। সকলেই এসেছিল। আর বসার ব্যবস্থা হয়েছিল সেই স্বপ্নের মতো করে আমাদের ছাদে। আলোচনার সময় অন ছিল আমাদের মোবাইলের অডিয়ো অপশন। বুঝতেই পারছ, এই লেখাও স্মৃতি ও শ্রুতি নির্ভর। হঠাৎ আমার মনে হল আমাদের বসাটা যে ছবি তৈরি করেছে, তা চন্দ্রবিন্দুর মতো। চন্দ্রবিন্দুর কোনও প্রতীকী তাৎপর্য আছে কি না ভাবতে গিয়ে দেখলাম, একমাত্র মৃতের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনে চন্দ্রবিন্দুর আলাদা ব্যবহার আছে, আর কিছু জানা নেই। ইতিমধ্যে পরিচয় পর্ব শেষ হয়েছিল। এরা কেউ-ই কারও পরিচিত ছিল না। যে যার নাম বলে পরিচয় করে নেওয়ার সময় আমি তাদের পেশা ও নিবাস যথাসম্ভব বলার চেষ্টা করেছি। এবং সবার শেষে বলেছিলাম, ‘আমার মনে হয়, সম্পর্কের এক নতুন পরিসর আমরা তৈরি করতে পেরেছি!’ কেউ কোনও কথা বলল না দেখে আমি বললাম, ‘আমার এই মনে হওয়া কি সত্য নয়?’
সুব্রত বলল, ‘আমার কাছে সত্য!’ অন্য সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমাদের কী মনে হচ্ছে?’
‘জিজ্ঞাসা-বিস্ময়’বন্ধু সত্যব্রত বলল, ‘নতুন সম্পর্ক বলতে তুমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছ— এটা ক্লিয়ার নয়!’ অধ্যাপক কল্যাণ বলল, ‘সম্পর্কটা নিশ্চয় সত্য কিন্তু নতুন পরিসর-ব্যাপারটা অস্পষ্ট লাগছে!’
আরও পড়ুন: বাংলাভাষাকে সঙ্গে নিয়ে হিল্লিদিল্লি

আর দু’জন, সায়ন (যে আমার উদ্দেশ্যের সাফল্য কামনা করেছিল) আর রুদ্র (যার চাওয়া আমার জীবন সুন্দর হোক)— এরা সত্যব্রত ও কল্যাণের মতোই বলল। আমি বললাম, ‘সাধারণত, প্রেম নিবেদন ব্যর্থ হলে সাধারণত সেই দু’টি মানুষের মধ্যে কোনও সম্পর্ক রচনার সম্ভাবনা আর থাকে না বরং প্রায়ই বীভৎস সব ঘটনায় পরিসমাপ্তি ঘটে— আমার ক্ষেত্রে তা তো ঘটেইনি! বরং তোমরা আমার বন্ধু হয়েছ— আমার মনের ইচ্ছাকে মূল্য দিয়েছ, শুভকামনা জানিয়েছ; সুব্রত আমাকে তার কাজের সহযোগী করে নিয়েছে।’
এই ‘সহযোগী করে নেওয়া’র ব্যাপারটা আমি সুব্রতকে বলতে বলেছিলাম। সে বেশ গল্পের মতো করে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে। লোকাল নিউজ পেপারে সংবাদ হওয়ার কথা জেনে কল্যাণ আর সায়ন মনে করতে পারল ঘটনাটা। আর পাড়ার ছেলে হিসাবে রুদ্র তো ব্যাপারটা জানতই! সুব্রতর গল্প বলা শেষ হলে আমি আমার কথায় ফিরে গেলাম, ‘বুঝতেই পারছ, এই সবমিলিয়ে আমার মনের এই উপলব্ধি! মানে— একটি মেয়েকে দেখে কোনও ছেলের মনে প্রেম জাগা মানে তো যৌন-প্রেম, তা যদি সফল না হয়, ছেলেটির বা মেয়েটির আরও যে সব সব কোয়ালিটি তা তো উভয়কে সমৃদ্ধ করতে পারে! জানি না, ঠিক এই ভাবনা থেকে তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখা শুরু হয়েছিল কি না, বলা মুশকিল কিন্তু এখন এই ব্যাখ্যাটা দিতে আমার ভালো লাগছে।’
সায়ন বলল, ‘সন্দেহ নেই, ব্যাপারটা ইউনিক! আরও কিছু বলো!’
আমি একটু হেসে বললাম, ‘থ্যাঙ্কস! বন্ধুর বন্ধু আমারও বন্ধু— এটা তো একটা তত্ত্ব, এই তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগে তোমরাও পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠবে, এই আশা কি আমি রাখতে পারি?’
কল্যাণ বলল, ‘অবশ্যই! কিন্তু পরিসরটাকে তুমি নতুন বলছ কেন?’
‘তোমরা প্রত্যেকেই— মনে হয়, আমার সঙ্গে একান্তে বাঁচতে চেয়েছিলে; মানে আমার ‘যোনি’তে তোমরা বাঁচতে চেয়েছিলে।
কিন্তু সেই সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আমার বেঁচে থাকায় তোমরা প্রত্যেকেই আছ! না কি নেই?’
সত্যব্রত বলল, ‘আছি-ই তো!’
‘না থাকলে কি-আর এই মিটিং হত!’ বলল রুদ্র, ‘আমাদের বেঁচে থাকাতেও তো তুমি আছ!’
আমি বললাম, ‘ঠিক। কীভাবে আছ? না-বন্ধুভাবে। মানে যৌনতার বাইরে, মননে আমরা একসঙ্গেই আছি! এই যৌনতা-বিযুক্ত পরিসরকে আমি নতুন পরিসর বলেছি।’
আরও পড়ুন: সাহিত্যের ইয়ারবুক (ঠিকানাপঞ্জি): বাংলা সাহিত্য-প্রেমীদের এক মূল্যবান সম্পদ

সকলেই ব্যাপারটাকে অনুধাবন করে যেন নীরব ছিল। তাকে সম্মতি ভেবে বললাম, ‘এবার বলো!’ ইতস্তত-ভাব দেখে বললাম, ‘ঠিক আছে, একটু মনে করিয়ে দিই, আমার বিয়ে না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্দেশ্য কী ছিল— এটা তোমাদের কার কী মনে হয়, জানতে চেয়েছিলাম। এই মিটিংয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার সময় সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ উদাহরণ হিসাবে রেখে, জানতে চেয়েছি, তেমন কোনও উদ্দেশ্য কি এই সিদ্ধান্তের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?’
সুব্রত বলল, ‘সিদ্ধার্থ সম্বন্ধে ইতিহাস বইতে যা পড়েছি, তার বাইরে কোনও ধারণা আমার নেই, তবে আজকের দিনে— জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর কারণ খুঁজতে বোধহয় কেউ আর সংসারত্যাগ করবে না।’
সুব্রতর কথায় আমি বেশ হতাশ হয়ে বললাম, ‘আমি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পারিনি! বেশ। বিষয়টা হল, বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি, তবু আমাকে তো এই সমাজেই থাকতে হবে! প্রশ্ন হল, সমাজ আমাকে কোন কাজের ভিত্তিতে আইডেন্টিটি দেবে, মানে কোন্ কাজ আমি করতে পারি— এখন আমি এটাই জানতে চাইছি!’
এবার সকলকেই কেমন হতাশ দেখাল। একটু পরে সত্যব্রত বলল, ‘বলা মুশকিল— আল্টিমেট সকলেই, এক কল্যাণদা ছাড়া, আমরা বেকার— কাজের জায়গা থেকে কোন্ পরিচয় আমাদের গড়ে উঠবে— এটা বলার মতো জ্ঞানগম্যি অন্তত আমার নেই!’
আমি বললাম, ‘সায়নদা, আমার সিদ্ধান্ত জেনে তুমি আমার সাফল্য কামনা করেছিলে— তুমি কি আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কোনও আন্দাজ করতে পেরেছিলে সেদিন?’
একটু ভেবে সে বলল, ‘মনে করতে পারছি না!’
‘নিশ্চয়ই কথার কথা ছিল না?’
‘হয়তো তা-ই ছিল!’
আমার মনে হল, স্বাভাবিক। নিজেই আমি উদ্দেশ্য ভুলে গেছি! আমি রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি বলো তো বন্ধু, কোন্ পথে গেলে আমার জীবন সুন্দর হবে?’
আরও পড়ুন: তামিল পত্রিকা ‘বিবেকচিন্তামণি’

যেন কোনও কিছু না ভেবেই রুদ্র বলল, ‘গত এক বছর তুমি যে পথ ধরে হেঁটেছ সেই পথেই হাঁটো, মাই ফ্রেন্ড!’
কথাটা যেন একটা ‘স্পার্ক’ দিল! বললাম, ‘মানে?’
সে বলল, ‘এই এক বছর তোমাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে!’
তখন মনে পড়ল, সেই জন্মদিনের পর আরও দুই জন্মদিনে এদের মধ্যে কেবল রুদ্রই আমাকে ‘আরও সুন্দর হও!’ বলে উইশ করেছে, আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
কল্যাণ বলল, ‘রুদ্র, খুব ভালো বলেছ, ভাই! এই পথেই গার্গী-দিদিমণির একটা নতুন আইডেন্টিটি গড়ে উঠবে, আমরা আশা রাখতে পারি!’
‘থ্যাঙ্কু কল্যাণদা!’ বলে আমি অন্যদের উদ্দেশে বললাম, ‘তোমরা জানো— আমি বিনতা, গার্গী আমার পাওয়া নাম, ও-ই দিয়েছে!’ আমার ডান তর্জনী কল্যাণকে নির্দিষ্ট করল! আর তখন কেন জানি না আর চার জনের হাতে বেজে উঠল তালি।
তার পর চা-জলখাবার পর্ব শেষ হলে আমি বললাম, ‘পরস্পরের বেঁচে থাকায় আমরা কি কোনও ‘শেয়ার’ রাখতে পারি, যদি পারি, তা কীভাবে? এই ব্যাপারটা আমি সকলকে ভাবতে বলছি! আগামী সিটিংয়ে এটা আলোচনার বিষয় হতে পারে।’
রুদ্র বলল, ‘মানে কন্ট্রিবিউশন— অবদান?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এটাই ঠিক কথা— যেমন, আমার জীবনে তোমাদের অবদান!’
আর তখনই ভাবনা এলো, এদের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি কেন?
উপন্যাসের বাকি অংশগুলি পড়তে ক্লিক করুন:
সম্বুদ্ধজাতিকা (১ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (২য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৩য় অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৪র্থ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৫ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (ষষ্ঠ অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৭ম অংশ)
সম্বুদ্ধজাতিকা (৮ম অংশ)