শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
মধ্যরাত্রের কলকাতা শাসনকারী যে কুসুমিত যুবকদলের কথা মিথ হয়ে রয়ে গেছে প্রতিটি মননকামী কবিতাভুক, রোমন্থনপ্রিয় পাঠকের কাছে, তার শেষতম প্রতিনিধি, অন্তিম গন্ধপরাগটিও ঝরে গেল কিছুদিন আগে। গদ্যরীতির সুষমা অন্যমাত্রায় ধরা দিয়েছে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে। স্পষ্টবাক্, হিরণ্যরেতা এই কবি-লেখক শুধু ‘সহবাস’-এর শরীরী-অধিকার সংক্রান্ত বিতর্কের জন্যই নন, পরিচিত তাঁর গাঢ়তর, গূঢ়তর অনুভবগুলির জন্যও। তিরিশের দশকের শুরুতে জন্ম। চূড়ান্ত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অনিশ্চয়তার পঞ্চাশ-ষাটে তিনি যুবক! এই সেই সময় যখন নাট্যকার জন অসবোর্ন লিখছেন, ক্ষয়িষ্ণু যুবসমাজের প্রতিভূ জিমি পোর্টারের কথা (Look back in Anger), এই সেই সময়, যখন জননী, জন্মভূমি হোক বা স্বাধীনতা, প্রশ্ন চিহ্নেরা ঝুলে রয়েছে অথর্ব বৃদ্ধের হাইড্রোসিলের মতোই। নারী, জীবন, যাপন সব বিষয়েই মত্ত-শঙ্কিত এক দেশজ ন্যারেটিভের বুকে দাঁড়িয়ে শরৎ নিজেকে প্রকাশ করছেন ভিন্নতর অনুভব দিয়েই। তাতে কি যুগাচার মেনেই অঙ্গার নেই? অস্বস্তি নেই? অকুণ্ঠিত দ্বেষ-বিষয়ক হুংকার নেই? দেখা যাক দু-একটি উদাহরণ:
আরও পড়ুন: সাক্ষাৎকার: চিত্রপরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য
বেগুন
আমি গোল বেগুন ফুটো করে তার মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে চাই।
চারদিকে এত মাছি, এত ফড়িং
চেতনার চৌকো চেহারায় ঠোক্কর লাগে।
চোখে আলো লাগে।
আমি পোকার মত শুয়ে থাকতে চাই বেগুনের মধ্যে বেগুন হয়ে।
বেগুনের শাঁস খেয়ে, বেগুনের গদিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে বুঝতে চাই
জন্মমৃত্যুর চক্রান্ত।
বেগুনের বালিশে মাথা রেখে বেগুন মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে চাই।
বেগুনকে জাপটে ধরে শুনতে চাই তার ভেতরের বীজ
ফোটার চিকচিক শব্দ।
আমি মোহকূপে ডুবে যাবো।
আরও ভেতরে ঢুকে যাবো, আরও ঠান্ডার মধ্যে, বাঁকা পথে, যাতে আলো
না গায়ে লাগে।
আমি বুঁদ হয়ে থাকবো বেগুনরসের নেশায়।
তারপর একদিন আরামের কষ্টে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মিশে যাবো বেগুনের সঙ্গে।
বেগুনের বাইরের পালিশ দেখে তোমরা বুঝতেই পারবে না, ভেতরে কে,
ভেতরে কেন।
‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’ (১৭৯৮) পরবর্তী যেকোনও লেখাতেই সাধারণী, বাস্তবের ছোঁয়া, শব্দ, কল্প সহজবোধ্য হয়ে এসেছিল। ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদি ভাষাভঙ্গিমা ভেঙে গড়ে উঠেছিল লোকায়ত পদ। কৃষক, শ্রমিক, কারিগরের ভাষা! কিন্তু এ যেন এক নতুনতর অভিঘাত। বেকার, বৌদ্ধিক, ক্রিয়াশীল, উর্বর যুবকের নিজস্ব সদ্য আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিকে পা দেওয়া সংস্কৃতি তার জল-হাওয়া দিয়ে যেন বীজ বুনছে বিষফুলের। Les Fleurs du mal-এর বোদল্যেয়র চৈতন্যের বিষাদ-গাথায় যেন পদছাপ ফেলছেন শহর কলকাতার বাঙালি বুকে। ‘আমি’ এবং ‘আমার’-এর মধ্যকার অস্তিত্বের সংকট যেভাবে ধরা পড়েছে কবির লেখায়, তা সুনীল-শক্তি-সন্দীপন ধারার বিপ্রতীপে অদ্ভুতভাবে নিজস্বী! মৌলিকত্বের ঈশ্বরত্ব স্পর্শকারী।
আবার এই লেখকই যখন ফিরে আসেন কাব্যিক, মরন্তুদ, নিত্যলিপ্ত প্রীতির কথায়, তখন অন্য আরেক ভঙ্গি ফুটে ওঠে। কঠিন, নিহিত আধুনিকের বহির্বাস খসে, অহং-পলান্ন অভিমানে ভেসে গিয়ে যেন ভিতরের মর্মতণ্ডুল ফুটে ওঠে ভোররাতের অন্ধকার থেকে জেগে ওঠা ঝিমঝিমে শুকতারার মতো।
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া গবেষণাগারের খোঁজে
গত বছর এমনই জুন মাসে
আপনি আমায় দিয়েছিলেন মুঠো ভর্তি বকুল
বলেছিলেন, ফুল না ওরা, কথা।
আমার কোনো কথা ছিল না। কথা বলিনি—
গত বছর এমনই জুন মাসে।
তখন থেকে লোকে আমায় দেখতে পেলে ‘বকুল শোন’ ‘এই বকুল’ বলে
টিটকিরি দেয়, হাসে।
ওদিকে আর যাই না। ভয়।
বড়ো নিঝুম। বখাটে ছেলেগুলো।
তাছাড়া যদি হঠাৎ ভুলে বকুল ফুলে লাগে পায়ের ধুলো!
কুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আপনি নিজে কুড়িয়ে দিয়েছিলেন
গত বছর এমনই জুন মাসে।
মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব অনুসারে সাধারণত: আত্মছবি বা ‘সেলফ’ বা সাদা বাংলায় ‘আমি’-কে ভালোবাসার কয়েকটি ধরন আছে। এককথায় একে নার্সিসিসম নাম দেওয়া হলেও তার মধ্যে, vulnerable, Grandiose, malignant ইত্যাদি নানা উপ-পর্যায় রয়েছে। লিরিক্যাল কবির ‘আমি’টিকে ভেঙেচুরে চিরপ্রেমিক বিরহীর ‘গড কমপ্লেক্স’ নামের ছদ্ম-তুচ্ছ হবার অহংকে ডুবিয়ে যে কবি এখানে ফুটে ওঠেন, “আমার কিছু ভালো লাগে না, আপনি ভালো আছেন?” নামের শেষোক্ত পঙ্ক্তিতে বৃক্ষপূজাহেন যে গভীর, উদাত্ত এবং সামান্য রক্তপাত, তা-ই শরতের সিগনেচার স্টাইলকে নির্দেশ করে।
এই শরৎই আবার ‘দেশ’ পত্রিকার হীরকজয়ন্তী সংকলনে লিখছেন সভ্যতার প্রাদুর্ভাবের কথা। সংকট, যা কিনা বিশ্বজনীন, কবির কলমে তা-ই একান্ত ব্যক্তিগত, অভ্যন্তরীণ, এবং সে কারণেই সূচিভেদ্য!
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের নিরিখে বিরলতমদের একজন হাসান আজিজুল হক
মানুষের পাশাপাশি
…
শুনি চিন দেশে পাখি নেই।
ওরা যে ডাকাত ছিল, বলে কাকাতুয়া
ওদের বিলোপ ছিল বিষম জরুরি, জেনে রাখো
প্রয়োজন বুঝেছেন, অন্তর বোঝেননি সাম্যবাদী, তাই
গাছেরা নিঃসঙ্গ চিনে, মেঘেরা অনাথ।
নাকি এতদিনে
আলাস্কার, সাইবেরিয়ার
নীলাভ ধূসর টিল
মানুষের পাশাপাশি বাসযোগ্যতার কথা ভেবে ক্ষমা করে ফিরেছে আবার!
ভয়ে ভয়ে দেখে গেছে চিনাজল?
আমি যে পাখির চোখে সন্ত্রাস দেখেছিও বহুবার।
কী অদ্ভুত আশ্চর্য গদ্য! অথচ প্রায় চোখেই পড়ে না, এরকম ভঙ্গিতে লেখা অক্ষরবৃত্ত। ২+২+২+২, অথবা ৩+৩+২, অথবা ৪+৪+৬। ছন্দ আছে অথচ তা যেন অজানা মন্দিরের থেকে চুঁইয়ে আসা স্তিমিত ধূপগন্ধ! অতি সন্তর্পণ ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য শুধু! সাময়িক এবং দুর্জ্ঞেয়!
ছন্দের কথা যখন উঠলই, তখন স্বরবৃত্ত অথবা মাত্রাবৃত্তের, অপেক্ষাকৃত তরলতর যেকোনও একটির অন্তত, কথাটুকুও না জানালে কি চলে! দীর্ঘায়িত না করে থাক একটিই উদাহরণ:
তোমাকে
‘উদ্ধার করো’— তোমাকে বলেছি কবে,
তুমি বলেছিলে, ‘হবে একদিন হবে,
আপাতত নাও গোলাপের চারা দুটি,
ফুল হলে যদি অনুরূপা-নামে ফুটি।’
বাগান পাইনি, গোলাপ বাঁচেনি মোটে
টব ছিল দুটো, পুঁতেছি রজনী-জুঁই,
এখন সেখানে নিরাপদ ফুল ফোটে—
…
কবি, কৃত্তিবাস নামক কাব্যঝড়ের অন্যতম শরীক, চাটার্ড-অ্যাকাউন্টান্ট ‘সোনার হরিণ’-এর খোঁজ দিয়ে শুরু করে অন্তিম মুক্তিকামী মানুষটিকে এককথায়, সামান্য বাক্যে কীভাবেই বা ধরা সম্ভব। স্বর্গারোহণের মনস্কামনা নিয়ে পৌরাণিক যুগে যেরকম শ্যেনবেদী বানাবার কথা শোনা যায়, ঠিক সেরকমভাবেই বিষণ্ণ, বিষাক্ত, লবণাক্ততর সভ্যতা-সৈকতের বুকে গড়া বালির বাঁধ, আরক্ত-কাব্যবেদি শরতের একান্ত নিজস্ব। একে স্পর্শ করা যায় না, এ আসলে অপ্রমেয়, শুধু তার অনুভবটুকু করা যায় পূর্ণিমার আলোর মতো জ্যোৎস্নাভিসারাভাসে।
কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকার লেবুবন’ থেকে আর একটিই উদাহরণ দিয়ে ইতি টানব:
নালিশ
তখনও ট্রেনের কিছু দেরি আছে দেখে
আমি বিরক্ত হয়েছি।
মিথ্যে এত ছুটোছুটি
রিকশাওলাটার কাছে খুচরো পয়সা নেওয়াই হল না।
তখনও ট্রেনের কিছু দেরি ছিল তাই আমি ‘মাষ্টার মাষ্টার,
নালিশ লেখার খাতা দাও’—
বলে তার আপিসে ঢুকেছি।
…
আসলে নালিশ ছিল যথেষ্ট জোরালো
রেলকর্তপক্ষ কিংবা বিধাতা, সমাজ, রাজনীতি
জীবিকা, বন্ধুত্ব-সবকিছুর বিরুদ্ধে ছিল বিষম বিক্ষোভ।
অথচ কলম খুললে হিংসা চলে যায়। মনে হয়
ক্ষতি যা হবার তা-তো হয়ে গেছে
…
বিশাল খাতাটা পড়ে থাকে—
দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালোবাসি তাকে।
কবিতায় সাধারণত একটি অনিবার্য পঙ্ক্তি থাকে, যা বাকি গ্রহস্বরূপ পঙ্ক্তিগুলিকে একাকী সূর্যহেন টেনে নিয়ে আসে নিজের কক্ষপথে! উদ্দিষ্ট পঙ্ক্তিটিই সেই বিচ্ছুরিত প্রভা, বাকি সবই হয় তার পথ প্রশস্তকারী অথবা ব্যাখ্যাতা। এখানে সেই পঙ্ক্তিটি কী, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
কিটসের ‘fine excess’ নামে বিখ্যাত বিবিক্ত সূত্রটির কথা সর্বজনবিদিত। নবমী নিশির একলা প্রদীপের নিবাত শিখায় ঢেলে দেওয়া একপলা বাড়তি অশ্রুঢলঢল ঘি-এর লাবণ্য যেরকম, সেরকমই ওই ‘সামান্য ক্ষতি’, ওই ‘fine excess’। যেকোনও সত্যিকারের লেখায় ওই বাড়তিটুকু, ওই আভা, ওই প্রভাটুকুই গভীরের পাঠক-চোখ সন্ধান করে। এ জিনিস কবিতার শরীরে যতটা না থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে তার বাইরের মহাশরীরে (metaphysical body) যে শরীরের স্পর্শ-অভিমুখ মন, মনন। সেই অতিরিক্ত মর্মবাষ্পটুকু টের পাওয়া যায় শরতের লেখায়। স্থূল নয়, উচ্চকিত নয়, এ যেন প্রাচীন দীঘির স্নানান্ত কিশোরীর ফেলে যাওয়া জলপদছাপ।
এ যেন সেই মহাশূন্যস্থিত অক্ষহীন মহাশিবলিঙ্গ, যার উল্লেখমাত্রেই প্রলয় অনুভূত হয়।
অসাধারণ পর্যালোচনা, মুগ্ধ হলাম।
ভালোবাসা জানাই।
কবিতার বিশ্লেষণ হয় না। যে বোঝে সে বোঝে। তবু এরকম লেখা কবিতা পাঠের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
খুব ভালো আলোচনা। শরৎকুমারের কবিতা নিয়ে লেখিকার অনুভব এই লেখার মাধ্যমে বড় যত্ন করে ব্যক্ত করেছেন।
অনেক ধন্যবাদ জানাই
যখন থমকে যায় চারপাশ, এভাবেই কি ঝড়ের আদলে সৃষ্টির মখমলে ফুটে ওঠে শব্দের কারুকাজ! যৌক্তিকতার জমিনে…আহা! আনন্দ জলছাপ!
কবি শরৎকুমার কত বড় মাপের কবি বা তিনি বাংলা কবিতাকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছেন, এই নিছক গবেষণাধর্মীতার চৌকাঠ পার হয়ে এ লেখা কোথায় যে নিয়ে গিয়ে থামায়…নাঃ! বুঝে উঠতে পারলাম না…আর এই সীমাবদ্ধতার জন্য পাঠকের চেয়ে খুশী আর কেউ হতে পারেনা!
শরণ্যা, কতটা নিমজ্জিত হতে পারলে শব্দ, ভাষায় এমন আশ্চর্য আলাদীনের প্রদীপ জ্বলে ওঠে…এ এক অনুপম আরব্য রজনী হয়ে রইল!
দাদা, প্রণাম।
অসাধারণ লেখা৷তেমনি গভীর বিশ্লেষণ৷অনুভবে ছুঁয়ে থাকা৷ ভীষণ ভালো লেখা৷
দাদা, অনেক ধন্যবাদ।