শান্তিপুরের প্রথম বারোয়ারি ডাকাত কালী পূজা

তিরুপতি চক্রবর্তী
বোম্বাটকালী। শান্তিপুরের কালীপুজোর ইতিহাস ৫০০ বছরের অধিক পুরনো। এখানে বৈষ্ণব ভূমিতে শক্তির আরাধনার ইতিহাসও অনেক পুরনো। তাই এই কালী সাধনা বা তন্ত্র চর্চার ইতিহাস এক গৌরব-গাথার মতো ছড়িয়ে রয়েছে এই পবিত্র ভূমিতে। কম-বেশি ২০০০ পারিবারিক পুজো পালিত হয় এই শান্তিপুরে। তার সঙ্গে উল্লেখযোগ্য বারোয়ারি পুজোগুলিও। এই বারোয়ারি পুজোর মধ্যে অন্যতম, বোম্বাট মিলিটারি নামে এক সংগঠনের পুজো।
আরও পড়ুন: মালঞ্চের ৩০০ বছরের দক্ষিণা কালীর টেরাকোটার মন্দির এখন বয়সের ভারে জীর্ণ

ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে শান্তিপুরে দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। শান্তিপুরের মানুষকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে তখনকার যুবসমাজকে নিয়ে তৈরি হয় বোম্বাট মিলিটারি নামে একটি সংগঠন। কাশ্যপপাড়ার বাসিন্দা (শিশু কাকলী স্কুলের পাশে) ভুবন পণ্ডিত মশাই (মিউনিসপাল স্কুল)-এর ছেলে বিষ্টু ভটচাজ্-এর নেতৃত্বে শান্তিপুরের বাছাই করা ডাকাবুকো ছেলেদের নিয়ে তৈরি হয় এই সংগঠন। বিষ্টু ভটচাজ্ ছিলেন গোপাল পাঁঠার ভাবশিষ্য। শিয়ালদা অঞ্চল থেকে তামাম শান্তিপুর অবধি একটা খুনে বাহিনী গড়ে তোলেন। চারের দশকে প্রথমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এই দলের শক্তির আরাধনার জন্যই এই বোম্বাট কালীর ভাবনা। বিষ্টু ভটচাজ্ ছাড়াও দলের প্রথম সারিতে ছিলেন সুশীল পাল, মোহন রায়, জগন্ময় পাল, মিতু নন্দী পবিত্র চ্যাটার্জি, শ্যাম সুন্দর মুখার্জি, বিমল চ্যাটার্জি, ফুনু সান্যাল, সরোজ রায়, হিমাংশু চক্রবর্তী, বাপি পাঠক, সুচিত বাগচীর মতো বাংলার তৎকালীন দামাল ছেলেরা। যাদের হাত ধরেই শান্তিপুরে প্রথম ডাকাত কালীর উদ্ভব।
এই বোম্বাট মিলিটারির কাজে সব সময়েই ছিল অভিনবত্ব। এরাই ঠিক করেন, কালী পুজো করব এবং মূর্তি হবে অন্যরকম। শোনা গেল, তারকেশ্বরের কাছে বা সিঙ্গুরে একটি ভয়ংকর রূপের কালীমূর্তি আছে। বিষ্টু ভটচাজ্ ও পবিত্র চ্যাটার্জি দু’জন ভজা পালকে (অজিত পালের বাবা) নিয়ে গিয়ে মূর্তি দেখে এসে তৈরি হল শান্তিপুরের প্রথম ডাকাত কালি। এই কালীমূর্তির বাঁ-পা শিবের বুকে থাকায় বামা কালী নামেও খ্যাত হয়। বাম আবর্তে বা তন্ত্রের বাম আবর্তে এই দেবী আরাধোনা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: নৃসিংহবন্দিতা দেবী বংশবাটী-বিলাসিনী

১৯৪৬ সালে এই পুজোর মশাল নিয়ে যাওয়ার সময় ডাকঘর মোড়ে ব্রিটিশ পুলিশের তীব্র সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়, যা বিরাট আকার ধারণ করে। ওই বছর পূজা গুপ্ত উপায়ে হয়। কাশ্যপপাড়ার হিন্দু হাইস্কুলের একটি ঘরে এই পূজা করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালেও এই পূজা ওখানেই হয়। আবার ১৯৪৮-এ পলাতক বোম্বাট মিলিটারির সদস্যরা ফিরে আসে। তারা তাদের আরাধ্য দেবীকে তাদের স্থিরীকৃত জায়গা অর্থাৎ মিনু মুখার্জির বাড়ির দান করা জমিতে এই পূজো শুরু করে, যা আজও মহাসমারহে চলছে।
এটা নির্দিষ্ট কোনেও পাড়ার পুজো না হওয়ায় পরবর্তীতে শান্তিপুরের বিভিন্ন প্রান্তের যুবকদের নিয়ে সাড়ম্বরে মায়ের পুজো চলতে থাকে। তন্ত্র মতে বা শাক্ত মতে এই আরাধনা হয়ে থাকে। এই পুজোর এবছর ৭৫তম বর্ষ। কিন্তু করোনা আবহে শুধুমাত্র পুজোটাই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবছর।
সত্যের খাতিরে মশাল মিছিল, রেশনের কেরোসিন পাওয়া, অসহ্য দূষণ, বিজ্ঞান-পরিবেশ-মানবাধিকার সংগঠনের নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবাদ এবং সব শেষে মশাল ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়া এটারও উল্লেখ দরকার ছিল।