শ্যামসুন্দর মন্দির, বালিপোতা (মেদিনীপুর কোতওয়ালি থানা)

চিন্ময় দাশ
শাস্ত্রে নাকি বলেছে, নদী কোথাও উত্তরবাহিনী হলে, সেই স্থান অতি পবিত্র। সেখানে সমস্ত পুণ্যকর্ম সারা যায়। আনন্দিত মনে বসতবাড়ি বা দেবালয় গড়ে তোলা যায় সেই পুণ্যভূমিতে।
মেদিনীপুর শহর লাগোয়া কংসাবতী নদী পূর্ববাহিনী। শহর ছাড়িয়ে খানিক পূর্বমুখী নিম্নস্রোতে পাথরা গ্রাম। আরও সামান্য পথ পাড়ি দিয়ে, উত্তরমুখে বয়েছে নদীর স্রোত। সেখানে নদীর পশ্চিমে বড় মাপের জাগুল গ্রাম। পবিত্রভূমি জেনে, জাগুলে নদীর গা-ঘেঁষা ৫২ বিঘা বালুজমির উপর গড়খাই কেটে বাস্তু তৈরি করেছিলেন এক জমিদার। নাড়াজোল রাজার কাছ থেকে পত্তনি নিয়ে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। একে একে বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন বৃত্তির মানুষজন এসে বসতি গড়েছিল জমিদারকে ঘিরে। বালিভূমিতে বাস্তু (পোতা অর্থে বাস্তু বা ভিটেবাড়ি) গড়ে, নতুন জনপদটির নাম হয়েছিল― বালিপোতা।
আরও পড়ুন: একসময় কলকাতায় নানান ধরনের উপধারার গান নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছিল

সেকালে কংসাবতীর অববাহিকায় নীল এবং রেশমের প্রভূত উৎপাদন হত। পাথরার জমিদার মজুমদার-বংশ ধনবান হয়েছিলেন তারই বাণিজ্য থেকে। প্রায় অর্ধশত দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা। অনুমান করা হয়, বালিপোতার জমিদারবংশও নীল আর রেশমের ব্যবসা থেকে উপার্জন করতেন। বিশাল মাপের অট্টালিকার সঙ্গে, একেবারে রাজকীয় গড়নের একটি দেবালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা।
আর পড়ুন: একসময় কলকাতায় নানান ধরনের উপধারার গান নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছিল

জমিদার-বংশের বর্তমান উত্তর পুরুষ কিংবা এলাকার প্রবীণদের কাছে বহু অনুসন্ধানেও জমিদারবংশের ঠিকুজি-কুলুজির কিছুই জানা যায়নি। জানা যায়, কেবল এক জমিদারবাবুর কথা। কিংবদন্তির মতো আজও তাঁরই নামটুকু কেবল প্রবীণ মানুষদের মুখে মুখে ফেরে। তিনি রণজিৎ মহাপাত্র।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুরের গড় হরিপুরে শতায়ু পূর্ণ করা রামচন্দ্র মন্দির

এই জমিদার সম্পর্কে একটি দু’টি কথা বলা যেতে পারে, নিবন্ধের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও। ১. যেদিন জমিদারবাড়ির পুরনারীরা স্নানে যেতেন, সকাল না হতেই অট্টালিকার দেউড়ি থেকে নদীর বুক পর্যন্ত কাপড়ের কাণ্ডারি (সামিয়ানার মতো, ঘেরাটোপ) পড়ত। কাড়া-নাকাড়া বাজত বাতাস কাঁপিয়ে, যাতে প্রজাবর্গ কেউ এসে না পড়ে।
আর পড়ুন: সুধীন-শ্যামল জুটি এবং বাঙালিয়ানায় মোড়া জিঙ্গল বেল

২. শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। তাই জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, গিরি-গোবর্ধন পূজা, দোল উৎসব, রাস উৎসব, মকর সংক্রান্তি― বারো মাসে তেরো পার্বণের আয়োজন হত। তার ভিতর এলাহি আয়োজন হত রাস উৎসবে। বড় মাপের একটি রাসমঞ্চ ছিল মন্দিরের সামনের অঙ্গনে। বিশাল অনুষ্ঠানে যেমন হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হত, জমিদারবাবুও আসতেন রাজকীয় আয়োজনে। এমনই কেতাদূরস্ত ছিলেন রণজিৎ, অন্য পোশাক-পরিচ্ছদের কথা থাক, তাঁর নাকি কেবল মাথার পাগড়ি বেঁধে উঠতেই রাসযাত্রা শেষ হয়ে যেত।

সেই রাসমঞ্চটির অস্তিত্বটুকুও নেই আজ। মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া একটি ঢিবিই টিকে আছে কেবল। সেখানে এখন সবজির ক্ষেত। কোদাল-গাঁইতির কোপ পড়লে, মাটির তলায় চাপা পড়া রাসমন্দিরের চাতালটি তার অস্তিত্বের জানান দেয় মাঝেমাঝে।
মন্দিরটি গড়া হয়ছিল একেবারে রাজকীয় আঙ্গিকে। উঁচু পাদপীঠের উপর পশ্চিমমুখী দেবালয়। দ্বিতলবিশিষ্ট নবরত্ন রীতির সৌধ। নীচের বায়ু কোণ থেকে একটি সিঁড়ি রচিত আছে। উপর নীচ দু’টি তলেই সামনে প্রশস্ত অলিন্দ। তাতে প্রবেশের জন্য ইমারতি-রীতির স্তম্ভ এবং দরুণ-রীতির খিলানের তিনটি করে দ্বারপথ। দ্বিতলের গর্ভগৃহের দু-পাশে দু’টি পার্শ্ব-কক্ষ দেখা যায়।

প্রথমতলের মূল গর্ভগৃহটি বেশ প্রশস্ত। তাতে প্রবেশের একটিই দ্বারপথ। তবে দু-পাশে দু’টি প্রতিকৃতি-দ্বার রচিত আছে। মূল দ্বারপথের দুই প্রান্তে দু’টি দ্বারপালিকা মূর্তি স্থাপিত। গর্ভগৃহের এক কোণে একটি সুড়ঙ্গের বুজে আসা মুখ। সেই সুড়ঙ্গ কোথায় গিয়েছিল, নদীর ঘাট, না কি, জমিদারের অট্টালিকার অন্তঃপুর পর্যন্ত― আজ আর জানা যায় না।
নবরত্ন মন্দির। তবে জীর্ণ মন্দিরে কেন্দ্রীয় রত্নটির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই বললেই চলে। কোণের রত্নও সবগুলি টিকে নাই। তবে রত্নগুলি রচিত হয়েছিল ভারি সুচারু ভঙ্গিমায়। প্রতিটির বাঢ় এবং গণ্ডিজুড়ে কলিঙ্গ প্রভাবে রথ-বিভাজন করা। কেন্দ্রীয় রত্নে পঞ্চ-রথ এবং অন্যগুলিতে ত্রি-রথ বিভাজন। রত্নের গণ্ডি অংশগুলি পীঢ়-রীতিতে নির্মিত। ভূমির সমান্তরালে কতকগুলি থাক ভাগ করা। কোনও রত্নেই শীর্ষক অংশ টিকে নাই। ফলে, বেঁকি, আমলক, খাপুরি, কলস, বিুষ্ণচক্র– কিছুই আর প্রত্যক্ষ হয় না, কিছুই।

দেবালয়টির ভিতরের ছাদ বা সিলিং রচনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। সামনে উপর নীচের অলিন্দের সিলিং হয়েছে টানা-খিলান করে। উপর-নীচ দু’টি গর্ভগৃহের সিলিং হয়েছে চার দিকে অর্ধ-গম্বুজের উপর বড় আকারের গম্বুজ স্থাপন করে। তবে, রত্নগুলির মাথার ছাউনির সিলিং হয়েছে একটু ভিন্ন রীতিতে। সেগুলিতে চতুষ্কোণ-লহরা রীতি প্রয়োগ করা হয়েছে, দেখা যায়।
বিগ্রহ নেই কেন মন্দিরে? দু’টি কথা জেনেছি আমরা সমীক্ষা চালাবার সময়। একটি অভিমত হল, বর্গি আক্রমণের সময় বিধর্মী সেনাদের অনাচারের কারণে মন্দিরের সেবাপূজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভিন্ন একটি অভিমত হল― জমিদারের দেওয়ান নিজেই মন্দিরের বিগ্রহ চুরি করে, অন্য এক জমিদারের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেদিন থেকে বিগ্রহহীন মন্দিরে সেবাপূজা বন্ধ হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে দেবালয়টি।

ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা দেবালয়টি এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসের পথিক, মৃত্যুপথযাত্রী। সরকারি বেসরকারি কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরও উদ্বেগ বা উদ্যোগ কিছুই নেই জেলার এই প্রত্নসম্পদটি রক্ষা করবার। তবে সুখের কথা, স্থানীয় স্তরে উদ্যোগের সূচনা হয়েছে। সৌধটিকে রক্ষা করবার ডাক দিয়ে সক্রিয় হয়েছেন ইতিহাসপ্রেমী এক মানুষ, রামানন্দ সাউ। ব্রহ্ম-বেকার মানুষটি পাশে পেয়েছেন স্থানীয় একদল উৎসাহী যুবক আর গ্রামবাসীদের। বিগ্রহ স্থাপন করে, সেবাপূজার প্রচলন করেছেন মন্দির চত্বরে। একটি মেলারও প্রচলন করেছেন তাঁরা। পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে, জীর্ণ পরিত্যক্ত সৌধটি একদিন পুনর্জীবন ফিরে পাবে― এমন আশাতে বুক বেঁধেই, কাজে নেমেছেন উৎসাহী মানুষগুলি।

সাক্ষাৎকার
শ্রীরামানন্দ সাউ― ধর্মপুর। সর্বশ্রী মদন মোহন মহাপাত্র, লালমোহন দাস, দেবেন্দ্রনাথ দণ্ডপাট― বালিপোতা।
পথ-নির্দেশ
মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে, পূর্বমুখে নদীবাঁধ বরাবর হাতিহলকা আর পাথরা গ্রাম পার হয়ে, জাগুল-বালিপোতা গ্রাম। মন্দিরটি পথের একেবারে কোল-ঘেঁষা।