ছয় বিন্দুর জাদুকরের জন্মদিন: আজ বিশ্ব ব্রেল দিবস

ড.মাল্যবান চট্টোপাধ্যায়
দৃষ্টিশক্তি চলে গিয়েছিল তাঁর জন্মের তিন বছরের মধ্যেই, সঙ্গে ছিল অসুস্থতা― তাও রোগভোগের অল্প জীবনকালে তিনিই তৈরি করে গিয়েছিলেন একটি পথ, যার সাহায্যে দৃষ্টিশক্তি না থাকা মানুষজন পড়তে পারেন আজও। তিনি লুই ব্রেল।
আরও পড়ুন: ২০২০-র দশটি অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার

১৮০৯ সালে আজকের দিনেই ফ্রান্সের কুপভ্রে এলাকায় জন্মান লুই ব্রেল। উনিশ শতকের এই মানুষটি বুঝেছিলেন অন্ধ ব্যক্তিদেরকে শিক্ষা গ্রহণের অন্যতম অন্তরায় ছিল পাঠ করার সমস্যাটি। তখনও রেকর্ড করার কোনও মাধ্যম নেই, রয়েছে শুধু অন্য কারোর পাঠ শোনার মাধ্যমে জ্ঞান লাভের সুযোগ মাত্র। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি রোহিত কোনও মানুষ যদি নিজেই পড়তে চান, তাহলে তার উপায় কী হবে। তাই নিয়ে ভেবেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: দু’হাজার কুড়িতে কুড়িয়ে রাখুন

ব্রেলের বাবা ছিলেন একজন চামড়া ব্যবসায়ী। চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান ব্রেল আকস্মিকভাবে এক চোখে সুচের গুঁতো খেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারানোর দিকে এগিয়ে যান তিনবছর বয়সে। সে যুগে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রচলন ছিল না, ছিল না উপযুক্ত ওষুধ। তাই ক্ষতিগ্রস্ত চোখ সংক্রমিত এবং তাবিস্তৃত হয়ে অপর চোখকেও। ফলশ্রুতিতে তিনি অন্ধ হয়ে যান চিরকালের জন্য। তবে তাঁর সৌভাগ্য যে, তিনি লেখাপড়া চালাতে পেরেছিলেন।
আরও পড়ুন: ২০২০-র বিস্ময়কর প্রাণী

দশ বছর বয়সে অন্ধদের উপযোগী রাজকীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি ভর্তি হন। সেখানে ব্রেল মেধাবী ছাত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞান এবং সংগীতে দক্ষতা দেখান। এর সূত্রে পরবর্তীতে তিনি চার্চের অর্গ্যান যন্ত্রবাদক হিসেবে যোগদানও করেছিলেন। তবে মাথায় ছিল অন্য ভাবটিও। তাই দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তা ও কল্যাণার্থে তিনি আবিষ্কার করেন এক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। এক থেকে ছয়টি বিন্দুতে তৈরি বিভিন্ন প্যাটার্নে আঙুলের স্পর্শের মাধ্যমে বিশ্বের লাখো লাখো দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ যে বর্তমানে পাঠ করতে পারেন, তার কৃতিত্ব এই মানুষটিরই।
আরও পড়ুন: গণিত দিবসে রামানুজন ও তাঁর বন্ধুত্বের কথা

বর্তমানে এই পদ্ধতিটি বিশ্বের সর্বত্র পরিচিতি পেয়েছে ও প্রচলিত সকল ভাষায় গ্রহণ করা হয়েছে। তার এই কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি জানিয়েছে বিশ্ব। কুপভ্রে এলাকায় অবস্থিত ব্রেলের শৈশবকালীন বাড়িটিকে ঐতিহাসিক ভবন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে লুইস ব্রেল যাদুঘর। ওই শহরের চত্বরে বৃহৎ আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভও রয়েছে, যা ব্রেল স্কোয়ার নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন: ৯,০০০ বছর মহিলার দেহাবশেষ আবিষ্কার এবং প্রচলিত ধারণার উল্টো পুরাণ

২০০৯ সালে তাঁর দ্বি-শতবর্ষ জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে বিশ্বের সর্বত্র যথাযোগ্য মর্যাদার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। যাতে তাঁর জীবন, কর্ম ও ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল। বেলজিয়াম এবং ইতালিতে দুই ইউরো, ভারতে দুই রুপি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ডলার মূল্যমানের মুদ্রা প্রকাশ করা হয়, তাঁর সম্মানে। ভারত সরকার তাঁর সম্মানে প্রকাশ করে পাঁচ টাকা মূল্যের ডাকটিকিটও। ২০১৮ সালের নভেম্বরের সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০১৯ সাল থেকে তাঁর জন্মদিনকে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব ব্রেল দিবস হিসেবে। সেই সূত্রে আজ তৃতীয় বিশ্ব ব্রেল দিবস।
আরও পড়ুন: প্লাজমা-পোয়েম-প্রেয়ার একসূত্রে গেঁথেছে জগদীশ-রবি ঠাকুর-স্বামীজিকে

তাঁর জীবন অল্পদিনের ছিল, ১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি যক্ষ্মা রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর স্বল্প জীবনকালে তিনি এটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষ চাইলে অসম্ভব শব্দটিকেই মুছে দিতে পারে।

লেখক আসানসোল গার্লস কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
Khub Monograhi Nibandha. Bhalo Laglo pore.
দারুন লাগলো।