দীপান্বিতা হাজরা
ছোটবেলায় ১৫ আগস্টের দিন সকালবেলা মনটা ভারী খুশি খুশি হয়ে যেত। ছোট থেকেই ভীষণ কল্পনাপ্রবণ আমি। মনে হত আমার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পাড়া, আকাশ, বাতাস, পুকুর, এমনকী পাশের বাড়ির পুচকি বিড়ালটাও খুব খুশি। সকাল সকাল ঘুম ভেঙেই শুনতাম ইস্কুল মাঠের মাইক থেকে গমগমে গলায় গান ভেসে আসছে “মুক্তির মন্দির সোপান তলে/ কত প্রাণ হল বলিদান।” পরে জেনেছি ওই গলাটা শিল্পী সবিতাব্রত দত্তর। ১৫ আগস্টের গান মানেই সবিতাব্রত দত্ত। ওনার ক্যাসেট ‘গৌরব গাথা’, যা ১৯৮৭ সালের ৮ জানুয়ারিতে রিলিজ করেছিল, সেই ক্যাসেটে অনেকগুলো গান ছিল— ১। উঠো গো ভারতলক্ষ্মী, ২। রাম রহিম না জুদা করো ভাই আরও অনেক। এর মধ্যে উঠো গো ভারত লক্ষ্মী গানটা পাপা মাঝেমধ্যেই খোলা গলায় গেয়ে উঠত। আমি তখন ছোট, মানে পাপার কাঁধে কোলে চেপে ঘুরে বেড়াই। পাপা তখন গাইছে— “জননী গো লহ তুলে বক্ষে/ সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে/ কাঁদিছে তব চরণতলে/ ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো।” আমি আধো আধো গলায় পাপার সঙ্গে গলা মেলাবার চেষ্টা করে চলেছি— “টিংসুটি কোটি নর নারী গ”, মানে এইটুকুই উচ্চারণ করতে পারতাম তখন।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার সূর্যদের লড়াইধন্য সেইসব পবিত্র ভূমি
ও হ্যাঁ যা বলছিলাম, ১৫ আগস্টের গান। আমরা, মানে আমি এবং পাড়ার কিছু বন্ধুরা বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই গান প্র্যাকটিস শুরু করতাম ইস্কুল মাঠের অনুষ্ঠানে গাইব বলে। আমার প্রথম শেখা গান ‘আমরা সবাই রাজা’, বন্ধুরা কেউ গাইত ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’, ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, তারপর কোরাসে গাওয়া হত ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়’, ‘এবার তোর মরা গাঙে’। আমি স্টেজে গান গাইতে বা আবৃত্তি করতে ভীষণ ভয় পেতাম। নাম অ্যানাউন্স হয়েছে অথচ এদিকে আমি তো কিছুতেই স্টেজে উঠব না। মা-ও ছাড়বে না। শেষে গ্রিন রুমে ঠাস করে একটা থাপ্পড় খেলাম। তারপর ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে স্টেজে উঠে নমস্কার করে গান আর কবিতার মাঝামাঝি কিছু একটা করে তাড়াহুড়ো করে নেমে আবার একটা থাপ্পড় খাওয়া, এই হল আমার ১৫ আগস্টের ছোটবেলার স্মৃতি। তারপর একটু করে বড় হলাম। তখন শিখলাম ‘ও আমার দেশের মাটি’, কেন চেয়ে আছ গো মা। তখন ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমা সদ্য সদ্য দেখেছি, গুরুজির কাছে বায়না করে শিখলুম ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’। তারপর গুরুমার কাছে শিখেছিলাম দেশ রাগে ‘বন্দে মাতরম’।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা আন্দোলনে মুর্শিদাবাদ
মিউজিক নিয়ে ইংরেজি ও হিন্দি মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েশন করতে গিয়ে অনেক হিন্দি দেশাত্মবোধক গান শিখলাম তার মধ্যে একটি মনে পড়ছে ‘হাম সব ভারতীয় হ্যায়’। ‘সুভাষ চন্দ্র’ সিনেমাটি দেখার পর ‘একবার বিদায় দে মা’ গানটি শুনে আবেগে গলা বুজে এসেছিল। তারপর যখনি গানটা গাওয়ার চেষ্টা করেছি একতারা বাজিয়ে ততবারই চোখ দু’টো জলে ভরে গিয়েছে। অনেক পরে পরিচয় হয়েছে গণনাট্যের গানের সঙ্গে। সলিল-হেমন্তর যুগলবন্দি ‘ধান কাটার গান’, ‘অবাক পৃথিবী’, সুবীর সেনের ‘ঐ উজ্জ্বল দিন’ এই সব গানে ভরে উঠত আমার ১৫ আগস্ট। আমাদের বাড়িতে রাতে ঘুমোবার আগে গান শোনার রেওয়াজ আছে, বাড়ির ড্রয়িং রুমে একটা ছোট বক্স আছে, গান বা সেতার চালালে সমস্ত রুম থেকেই শোনা যায়। একদিন রাতে পাপা বলল, আজ নাটক শোনাব। শুনলাম উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’। ওই নাটকেই একটি গান শুনেছিলাম মান্নাদের কণ্ঠে ‘স্বদেশ আমার কিবা জ্যোতির্মণ্ডলী’। নাটকটি চিরদিনের মতো মনে গেঁথে গিয়েছে।

ট্রেনে একবার এক বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে খঞ্জনি বাজিয়ে গাইতে শুনেছিলাম— ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।’ ছোট থেকেই জাতীয় সংগীত যতবার শুনতাম চোখ দু’টো জলে ভরে উঠত। এতগুলো বছর কেটে গিয়েছে, ১৫ আগস্টের গানে বারবার সেই ছোটবেলার আনন্দকেই খুঁজে বেড়াই। মনে পড়ে সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে বলা, ‘বন্দে মাতরম’।
বেশ ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে। পুরনো দিনগুলিকে কিছুক্ষনের জন্য ফিরে পেলাম যেন।