সুধীন-শ্যামল জুটি এবং বাঙালিয়ানায় মোড়া জিঙ্গল বেল

ইন্দ্রজিৎ মেঘ
কী থেকে কী হয়, কেউ জানে না। জানেন কেবল শিল্পী। বড়দিনের আলোচনাটা শুরু করা যাক এক স্বনামধন্য বাঙালি সুরকারের পুত্রের কথা দিয়ে। সুরকারের নাম সুধীন দাশগুপ্ত। তাঁর ছেলে সৌম্য তখন ছোট। সে তার বাবার কাছে একবার আবদার করে বসল— তার জন্য বানাতে হবে গান। ছোট্ট সৌম্য বলল, ‘‘বাবা তুমি তো নানান রকম গান বানাও। বাচ্চাদের নিয়ে তো কখনও কোন গান বানাও না। আর কিছু শুনব না। এবার তোমাকে বাচ্চাদের একটা গান বানাতেই হবে। বাবা ছোটদের নিয়ে গান তৈরি করার কথা দিলেন তাঁর ছেলেকে। তবে এরপর পেরিয়ে গেল অনেকদিন। গান বানানো হল না। খুব স্বাভাবিকভাবে প্রবল মনখারাপ নিয়ে তার বাবার কাছে আবার ওই একই আবদার করল। ছেলের এই নাছোড় আবদারে বাবা সুধীন দাশগুপ্ত ছোটদের নিয়ে গান বানাতে বসলেন। সেই সময় সৌম্যর সঙ্গে বাহাদুর নামে এক পরিচারক থাকত। সৌম্য ও বাহাদুর বয়সে ছিল সমান সমান।
আরও পড়ুন: মহামানব যিশু খ্রিস্ট, মানবপ্রেমের ঘনীভূত রূপ

সুধীনবাবু বললেন, ‘‘তোমার বাহাদুরকে নিয়েই আমি গান লিখব।” কথা রাখলেন তিনি। বাহাদুরকে নিয়েই তিনি লিখে ফেললেন, ‘‘ছোট্ট বাহাদুর যাচ্ছ কতদূর/ রাস্তা থেকে কিনে এনো গরম চানাচুর।” এরপর খুশির বাধ ভাঙল সৌম্য এবং বাহাদুরের। এই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৬৭-তে পুজোর গান তৈরি করতে বসলেন সুরকার। শ্যামল মিত্রের লিপে যাবে এই গান। কীরকম সুর হবে, গানের কথাই বা হবে কীরকম, সেসবই তখন ভাবনাচিন্তা চলছে। হঠাৎ তাঁর মাথায় এলো, আরে ছেলের জন্য তো একটা গান লিখেছিলাম, সেই সুরে তৈরি হয়ে গেল কালজয়ী গান। ‘ছোট্ট বাহাদুর যাচ্ছ কতদূর’ গুনগুন করতে করতে ওই ঘরেই তৈরি করে ফেললেন ‘‘কি নামে ডেকে বলব তোমাকে/ মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে…” জন্য তৈরি করা সুর রূপান্তরিত হল প্রেমের গানে। মানুষটি ছিলেন এমনই সৃষ্টিশীল।
আরও পড়ুন: বিশ্বজনীন ক্রিসমাস উৎসবের কিছু অভিনব উদ্যাপন

আজ বড়দিন। এদিনের সঙ্গে জিঙ্গল বেলের সম্পর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। বড়দিনের ঘণ্টা বাজিয়ে এই গান লিখেছিলেন জেমস লর্ড পিয়ারপন্ট (১৮২২-১৮৯৩)। ১৮৫৭ সালের শরৎকালে ‘দ্য ওয়ান হর্স ওপেন স্লেইগ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল এই গান। অনেকেই বলেন যে, অনেকটা স্কুলের সংগীতের ধাঁচে তৈরি হয়েছিল এই গান। যদিও ক্রিসমাসের সঙ্গে এটির কোনও সংযোগ নেই। এটি ক্রিসমাস সংগীত এবং ছুটির মরশুমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ১৮৫৭-র ১৬ সেপ্টেম্বর। সেদিন ব্ল্যাকফেস মিনস্ট্রেল পারফর্মার জনি পেল নামে এক শিল্পী অর্ডওয়ে থিয়েটার হলে গানটি পরিবেশন করেছিলেন।

এরপর এই গানটি নিয়ে মানুষের মনে আগ্রহ বাড়ে। ১৮৬০-৭০’এর দশকে পুস্তকের অংশ হিসাবে গানটিকে ব্যবহার করা হয়। আর তারপর তো ১৮৮০-র দশকে বিভিন্ন পার্লারে এবং কলেজে এই গান প্রদর্শিত হয়েছিল। ১৯৮৯-এ প্রথম এডিশন সিলিন্ডারে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে দুঃখের বিষয়, ক্রিসমাসের গান হিসেবে প্রথম এই রেকর্ডটি হারিয়ে গেছে। যদিও এই ঘটনার ঠিক নয় বছর পর অর্থাৎ ১৮৯৮-এর রেকর্ডটি আজও অক্ষত।

১৯নং হাই স্ট্রিট, মেডফোর্ড, ম্যাসাচুসেটস-এ ফলক
আজ থেকে প্রায় ১৬৩ বছর আগে তৈরি হওয়া এই গান গোটা পৃথিবীর মানুষকে আন্দোলিত করেছে। গানটি তৈরি হওয়ার ঠিক ৯৬ বছর পর বাংলার সুরের জগতেও ঘটে গিয়েছিল যুগান্তকারী এক ঘটনা। ১৯৫৩ সালে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে সুধীন দাশগুপ্তর সুরে জিঙ্গল বেলের সুরে মুক্তি পেয়েছিল ‘‘কতদূর কতদূর কোন অজানায়/ পথ ওই চলে গেছে সুদূরে কোথায়…” গানটির কথা লিখেছিলেন পবিত্র মিত্র। ২-২ ছন্দে তৈরি হয়েছিল এই গান। ‘ধা গে না তি না ক ধি না ধা’ ছন্দে কাহারবাতেও বাজতে পারে এই গান। সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া পাশ্চাত্যের প্রভাব। অ্যাকর্ডিয়ান, পিয়ানো ভায়োলিন, বাঁশি, গিটার সহযোগে বানানো হয়েছিল অপূর্ব এক সিম্ফোনি। বসানো হয়েছিল কোরাস।
শ্যামল মিত্র সুধীন দাশগুপ্ত
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা তথা ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে যা সত্যি ব্যতিক্রমী একটি কাজ। লন্ডনের রয়্যাল স্কুল অফ মিউজিক থেকে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন সুধীনবাবু। সেই সময়কার দিনে ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই হাতেগোনা। সেখানে থাকাকালীন তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন পাশ্চাত্য সংগীত নিয়ে। তারই হয়তো ফসল ছিল জিঙ্গল বেলের সুরে ‘কতদূর কতদূর কোন অজানায়’।
হ্যাঁ, এ-কথা বলছি, কারণ কথায় কেবল সুর বসিয়েই নয়, প্রিলিউড কিংবা অন্তরা শুরুর আগে বাদ্যযন্ত্রের যে কাজ তিনি করে দেখিয়েছিলেন, তা সুরসিদ্ধ না হলে সম্ভব হত না। সত্যিই তাই যে, কী থেকে কী হয় জানেন কেবল শিল্পী। আসলে সুধীন দাশগুপ্ত এবং শ্যামল মিত্রর বন্ধুত্বও ছিল হরিহর আত্মার মতো। কাছাকাছি থাকতেন দু’জন। তাই একে-অপরের বাড়িতে প্রায়ই বসত গানের আড্ডা। পিয়ানো বাজাতেন সুধীনবাবু। গাইতেন শ্যামল মিত্র। হয়তো এভাবেই তৈরি হয়েছিল বাঙালিয়ানায় মোড়া ‘জিঙ্গল বেল’। আজ বড়দিনে তাই সুধীন দাশগুপ্ত ও শ্যামল মিত্রের নামেই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলাম।
যাই লিখি না কেন কম হবে।
অনবদ্য।
Apurbo….. lekha ta poray samriddho holam…..
অসাধারন।
কোন অংশেই কম নয় ❤️