৯,০০০ বছর মহিলার দেহাবশেষ আবিষ্কার এবং প্রচলিত ধারণার উল্টো পুরাণ

অনিন্দ্য বর্মন
প্রাগৈতিহাসিক যুগে আনুমানিক ১,২০,০০,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম দ্বিপদ মানুষের আবির্ভাব হয়। সদ্য বাঁদর শ্রেণি থেকে বিবর্তিত এই প্রজাতি কৃষি, ফলমূল সংগ্রহ, মাছ ধরা এবং শিকারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। ব্যবহার করত পাথরের তৈরি অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি। তারা ক্রমে আগুনের ব্যবহার শেখে। পরবর্তীতে এদের বলা হল হোমো হ্যাবিলিস এবং তারপর হোমো ইরেকটাস। স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায় যে, এই সকল কাজ পুরুষরা করত। একে বলা হয়, ম্যান-হান্টার বা পুরুষ শিকারি। কিন্তু নতুন গবেষণার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকার করত যা এতদিনের চেনা নিয়মকে পালটে দিতে পারে।
আরও পড়ুন: সারফারোশি কি তামান্না: বিসমিল ও তাঁর সহযোগীদের আত্মত্যাগের কথা

বহুদিন থেকেই এটা ধরে নেওয়া হয়েছে, কৃষি এবং শিকারের কাজ করত পুরুষ প্রজাতি। তবে, বর্তমানে নতুন গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমেরিকায় এক মহিলার দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, যার পাশে তার শিকারের উপকরণ এবং অস্ত্র পাওয়া যায়। এই দেহটি আনুমানিক ৯,০০০ বছরের পুরনো অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েনস বা হাইডেলবার্জেনসিস সময়ের। মহিলার দেহ পাওয়া যায় আন্দিজ পাহাড়ের উচ্চতায়। এর নামকরণ করা হয়েছে উইলামায়া পাজা ইন্ডিভিজুয়াল ৬ অথবা সংক্ষেপে ডাব্লিউপিআই-৬। মহিলাকে অর্ধ-নমনীয় অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পাশে রাখা ছিল পাথরের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম। এর মধ্যে ছিল হালকা বর্শাজাতীয় শিকারের অস্ত্র। তর্কসাপেক্ষে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই ধরনের অস্ত্র বড় আকারের পশু শিকারের কাজে ব্যবহৃত হত।
মৃত্যুর সময় মহিলার বয়স ছিল ১৭ থেকে ১৯-এর মধ্যে। তার দাঁতের পেপটাইড, যা দিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়, সেই থেকে জানা গেছে― দেহটি একজন মহিলার। তার সমাধির পাশে বড় আকারের পশুর হাড় পাওয়া গেছে, যা বোঝায় যে, তার সমাজে শিকার ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালের লেখক-গবেষকেরা এই বিষয়টির ওপর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ওই সময়কার সমাধিক্ষেত্র এবং কঙ্কাল পরীক্ষা করে দেখেছেন, যাতে ওইরকমের আরও অস্ত্র এবং সামগ্রী পাওয়া যায়। ২৭টি কঙ্কালের লিঙ্গ নির্ধারণ করে দেখা যায় যে ৪১% হল মহিলার কঙ্কাল। এই থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে পুরুষ-মহিলা উভয়ই দলবদ্ধভাবে শিকার করত।
আরও পড়ুন: শীতের সকালে ৩৬-এর বিভীষিকায় ‘৪২-এর গ্রীষ্ম’ মনে পড়ে গেল

এই নতুন তথ্য পুরনো ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছে। কেবলই পুরুষরা শিকার করত― এই অনুমান যে ১০০% ঠিক নয়, সেই প্রমাণ আজ গবেষকদের নতুন দিশা দেখিয়েছে। হয়তো প্রাথমিকভাবে পুরুষরাই শিকার করত। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে যে, মহিলারাও শিকারে অংশগ্রহণ করত এবং একইসঙ্গে সক্রিয় ভূমিকাও পালন করত। এই গবেষণা থেকে হয়তো জানা যাবে যে, শিকারি এবং শিকার পন্থার বিবর্তন কীভাবে হয়েছিল। ফিলিপিনস-এর আগতা ফোরেজার্স-দের মধ্যে দেখা গেছে যে মহিলারাও শিকারে অংশ নেন। এর ফলে মহিলারা যে কেবল ঘরকন্নার কাজ করত― এমন ধারণা বদল হতে বাধ্য।

বর্তমানের শিকারি জনজাতির মধ্যে হালকা বর্শার ব্যবহার দেখা যায়। এগুলো খেলাধুলার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই সমস্ত গবেষণা করে প্রাগৈতিহাসিক পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক গঠনের অনুমান করে থাকেন।
রাশিয়ার সাংহির-এ প্রায় ৩৪,০০০ বছরের পুরনো সমাধি পাওয়া যায়। তাতে দু’টি কিশোরের দেহ ছিল। যার মধ্যে অনুমান করা হয় যে, একটি মেয়ে এবং তার বয়স আনুমানিক ৯ থেকে ১১ বছর। দু’জনেরই শরীরে কিছু অসমঞ্জস্য পাওয়া যায়। তাদের পাশে ছিল ১৬টি হাতির দাঁতের তৈরি বর্শা, যা সেইসময়কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিকার সামগ্রী। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে সুইডেনে এক ভাইকিং যোদ্ধার দেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১৭-এ পরীক্ষা করার পর জানা যায় যে, দেহটি এক মহিলার। এর আগে মহিলা ভাইকিং যোদ্ধার তথ্য ছিল সম্পূর্ণ অজানা। এর ফলে অনেক বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে যায় এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

ব্রিটেনের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে, পুরুষের কাজ এবং মহিলার কাজকে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়ার কিছু সুবিধে আছে। যেমন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা এবং সন্তানকে স্তনপান করানোর জন্য মহিলারা বাড়িতে থাকলে এই দু’টি কাজই অনায়াসে করতে পারে। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক এই ছবি আমাদের দৈনন্দিনের অনেক ধারণাই পালটে দিয়েছে। আজ থেকে ১০,০০০ বছর আগে শিকার ছিল এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পেশা এবং জীবিকা। মানুষের বিবর্তনের সঙ্গেই শিকার, শিকারি এবং পন্থার বিবর্তন হয়েছে। আশা করা যায় গবেষণার মাধ্যমে আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে, যা দৃষ্টান্তমূলকভাবেই প্রাগৈতিহাসিক মহিলা শিকারির ধারণাটিকে বদ্ধমূল করে তুলবে।
অসাধারন।
অকল্পনীয়।